নূরুল ইসলাম : পুলিশ ব্যস্ত জঙ্গি নিয়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। রাজধানীতে বেড়ে গেছে মাদকের বেচাকেনা। যেসব এলাকায় জঙ্গি ইস্যুতে পুলিশের নজরদারি আছে, সেসব এলাকায় মহাসড়ককে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি পয়েন্টে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ঢাকার ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও সচ্ছল পরিবারে ঢুকে পড়েছে মাদক। এতে করে সংসারজীবনে অশান্তি ও ভাঙন লেগেই আছে। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ বরাবরই জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। বরং পুলিশকে ম্যানেজ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় আগে থেকেই ছড়িয়ে ছিল নিষিদ্ধ মাদক। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য গোপনে ও প্রকাশ্যে বিক্রি হতো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমজান মাসে পুলিশের তৎপরতায় মাদকের বেচাকেনা অনেকটা কমে যায়। রমজানের আগে পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক সভায় পুলিশের আইজি মাদক নির্মূলের কড়া নির্দেশনা দেন। পুলিশ তৎপর হলে মাদকের বেচাকেনা ানেকটা কমে যায়। কোনো কোনো থানায় মাদকবিরোধী বিশেষ টিম গঠন করার কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা গাঢাকা দিতে বাধ্য হয়। ঈদের আগে গুলশানে হামলার ঘটনার পর পুলিশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে জঙ্গি নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ ভিআইপি এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এছাড়া জঙ্গি নিয়ে পুলিশের বিশেষ অভিযান পরিচালনার করণে স্বাভাবিকভাবেই ভাটা পড়েছে মাদকবিরোধী অভিযানে। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় মাদকের ব্যবসা এখন জমজমাট। দিনে রাতে অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হোরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য। এ কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করছে থানা পুলিশের কতিপয় সোর্স, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা, ছাত্রনেতাসহ কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা। মাদকের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, থানার সোর্সরা আসামি ধরার নামে পুলিশের সঙ্গে গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তারাই টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার কেউ মাদক বিক্রিতে বাধা দিলে সোর্সরা তাদেরকে কৌশলে মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছে। ভুক্তভোগিরা জানান, ৫৪ ধারা বাতিলের পর নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে মাদক মামলার ব্যবহার বেড়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশের কতিপয় সোর্স নামধারী মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে মাদক সংগ্রহ করা হয়। মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে পুলিশের সোর্সরাই। বিনিময়ে সোর্সদেরকে প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। সোর্সদেরকে টাকা না দিলে কোনো না কোনোভাবে পুলিশের হাতে ধরা খেতে হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশের কারণে পাড়া-মহল্লায় সুবিধা করতে না পেরে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের স্পট পরিবর্তন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্পটে প্রকাশ্যে চলছে মাদক ব্যবসা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশানে হামলার ঘটনার পর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী এলাকায় জঙ্গি ইস্যুতে পুলিশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাদক ব্যবসায়ীচক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনিরআখড়া, শেখদি, রায়েরবাগ ও ডেমরা সড়কের ভাঙ্গাপ্রেস এলাকায় স্পট খুলে বসেছে। এসব স্পটে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে শনিরআখড়া ও শেখদি স্পটের মালিক লিটন ওরফে কুত্তা লিটন। তার সেলসম্যান হিসাবে কাজ করে হানিফ ও আজম। এরা বিক্রি করে হেরোইন ও ইয়াবা। প্রতিদিন কমপক্ষে লাখ টাকা বিক্রি হয়। এ কাজে সরাসরি সহায়তা করে পুলিশের সোর্স কবির, আসিফ ও সোবহান। এজন্য এরা প্রত্যেকে প্রতিদিন ৫শ’ টাকা করে পায়। সূত্র জানায়, এই তিন সোর্স পুলিশের গাড়িতে ঘোরে। মাদক ব্যবসায়ী কুত্তালিটনের কাছে থেকে টাকা পায় বলে এরা চিহ্নিত মাদকরে স্পটের ধারেকাছেও পুলিশের গাড়ি ভেড়ায় না। রায়েরবাগের স্পটের মালিক রানা, রাসেল, সাদ্দাম, অন্তর ও আমিরুল। এখানে সেলসম্যান হিসাবে কাজ করে মাসুম, জুয়েল ও লেচিং। এই স্পটের পাইকারি ডিলার ছাগলা বাবু। জিয়া সরণি গ্যাস রোডের বাসিন্দা মাদকের পাইকার ছাগলা বাবু বরাবরই থাকে পুলিশের নাগালের বাইরে। রমজানে মাদকবিরোধী অভিযানেও সে গাঢাকা দিয়েছিল। এখন পুলিশের তৎপরতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রায়েরবাগে অবস্থিত ডাব্লুজেড পাম্পে মাদকের স্পট বানিয়েছে। এখন থেকেও সোর্স কবির, আসিক, সোবহান নিয়মিত টাকা পায়। এই স্পটে প্রতিদিন দেড় লাখ টাকার মতো হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রি হয়। এ ছাড়া ডেমরা সড়কে ভাঙ্গাপ্রেস নামক স্থানে নাসিরের স্পট নামে একটি মাদকের স্পট আছে। নাসিরের বাসা রায়েরবাগে হলেও ব্যবসা করে ভাঙ্গাপ্রেসে। তার সহযোগি হিসাবে আছে রাজু নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী। এখানকার সেলসম্যান হিসাবে কাজ করে করিম, কিরণ, জালাল, হান্নান, রহিম, এরশাদ, আরমান, শুক্কুর ও আক্কাস। এদের সবার বাসা শেখদি এলাকায়। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এসব এলাকা ছাড়াও রাজধানীর শ্যামপুর, মতিঝিল, পল্টন, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, খিলগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, তুরাগ, খিলক্ষেত, সবুজবাগসহ বিভিন্ন থানা এলাকার সোর্স, প্রভাবশালী সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা, জেল ফেরত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করছে। শ্যামপুরে কয়েকদিন আগে মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ায় ৮ জুলাই রাতে খুন হয় শাহেদ নামে এক যুবক। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকার অ্যাডভোকেট ম-ল হত্যা মামলার আসামী মালেক রহমান মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ঢালকানগরসহ পুরো শ্যামপুর থানা এলাকা মাদকে ভাসছে। মালেকের শত শত সহযোগী প্রকাশ্যে বিক্রি করছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। এ নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে বা বাধা দিলে গেলেই তাকে প্রথমে হুমকী ধমকি এবং পরে মারপিট করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জেল থেকে বের হওয়ার পর মালেক তার আধিপত্য বিস্তারের জন্যই কোটি কোটি টাকার ধান্দায় মাদক ব্যবসা শুরু করে। শাহেদ তার বাড়ির আশপাশে ইয়াবা বিক্রিতে বাধা দিতো। এ কারণে তাকে বেশ কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছিল মালেকের লোকজন। শাহেদ খুন হওয়ার পর শ্যামপুর থানা পুলিশের ভ’মিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। পুলিশ খুনিদের গ্রেফতারের চেয়ে শাহেদের পরিবারকে নানাভাবে হয়রানিতেই বেশি মনোযোগী ছিল। তবে এ বিষয়ে নিহত শাহেদের পরিবারের কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।
কদমতলী থানার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার সোর্সের যোগসাজশে এখানকার মাদক ব্যবসা জমজমাট। কদমতলী থানা এলাকার দু’শতাধিক স্পটে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাদক বিক্রি হচ্ছে। এলাকাবাসী জানায়, বড়ইতলার বিল্লাল, দোলাইপাড়ের ৩নং গলির সরকারদলীয় নেতা দুলাল, শ্যামপুর পালপাড়ার মাদক সম্রাট ফরহাদ এই এলাকার সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী। এরা প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার মাদক বিক্রি করে। এ ছাড়াও যারা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছে তারা হলো, মুরাদপুর জিরো পয়েন্টে পিস্তল কামাল, বিড়ি ফ্যাক্টরী কাঙ্গালীর ছেলে সোহাগ, বউ বাজারে আনোয়ারের বউ আলেয়া ভাবী, সরাই মসজিদ রোডের মতি মিয়া, চায়না বাবুল, শ্যামপুর রানী স্টীলের পাশে মনসুরের ফার্মেসী, লাবুর বাড়ীর শাহেদ, বদনা রনি, লাইজু, ২৪/১ আলমবাগের মাদক স¤্রাট আউয়াল, আলাউদ্দিন, কমিশনার রোড মিষ্টির দোকানের মাহমুদের ভাই বাবু, ছোট শাকিল, ওয়াসার ঢালে বজলুর বউ, জামাই মনির, শ্যামপুর ঢাকা ম্যাচ কলোনীর হানিফ, জুরাইন ঋষিপাড়ার রানা ও লাকী, মুরাদপুর ডিপটি গলির জুম্মন, দুলাল, জুবায়ের, শাহ আলম ও বিনা। দনিয়া এ কে স্কুলের গলির দারোগাবাড়ী ১ নং সড়কে ফেন্সিডিল বিক্রি করে দেলোয়ার, হাতকাটা ওয়াসিম, মুরাদপুর পেট্রোল পাম্পে গাঁজা বিক্রি করে আরিফ, মুরাদপুর হাইস্কুল রোডের আকবরের ছেলে বার রুবেল, ইয়াবা ব্যাবসায়ী ডেউয়া সুমন, জুরাইন বৌবাজারের প্যাথেডিন ব্যবসায়ী নাসিমা, আলম মার্কেটের হিরোইন বিক্রেতা শামীম, খাল পাড়ের তাইজু, কালা বাজারের হিরোইন বিক্রেতা হাকিম, শ্যামপুর নূতন রাস্তার জনি, সোহাগ, ঋষি পাড়ার বিয়ার ব্যবসায়ী জাকির ও মোশারফ। দনিয়া বাজারের চান্দু শাহীন, আকবর, দনিয়া আদর্শ স্কুল গলির রাসেল, আদম, ইতি, হাফিজুল, বগা মাসুম, কোকিলার ভাগ্নে নাঈম, রায়েরবাগের বাহার, সোহেল, সাহেব মিয়া, স্বপন কসাই, মুরাদ, নূরু, রফিক, ধোলাইপাড় ডিপটির গলির ফারুক, রহিম, সোর্স দুলাল, বাপ্পী ও রাজু। এলাকাবাসী জানায়, এদের মধ্যে অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসায়ী। থানা পুলিশের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সাথে এরা যোগাযোগ রক্ষা করে ইয়াবা বিক্রি করে থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান সব সময়ই অব্যাহত আছে। নিয়মিতই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চালানসহ ধরা হচ্ছে। তিনি বলেন, সমাজকে কলুষিত করা মাদক ব্যবসা ও সেবনকে কেবল আইন দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেটা আমরা করছি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন