বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ, বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট

প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : অতিবৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্ত এলাকায় রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে পাট, সবজি, কলাসহ আমন বীজতলা।
এসব এলাকার বেশিরভাগ নলকূপ পানিতে তলিয়ে থাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে বন্যাকবলিতরা। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সেইসাথে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে হচ্ছে সর্বস্বান্ত। সীমান্ত নদী ভাঙনকবলিত এলাকার পরিস্থিতি আরও শোচনীয় বলে জানা গেছে।
চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার, এলাসিনে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার এবং জারিয়াজঞ্জাইলে কংস নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়াও ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, টঙ্গীখাল, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বংশি, পুনর্ভবা, টাংগু, মহানন্দা, ছোট যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙা, কপোতাক্ষ, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, ধলাই, যাদুকাটা, সুমেশ্বরি, মেঘনা, গোমতি, মহুরি, হালদা, সাংগু ও মাতামুহুরিসহ ৭১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। অপরদিকে, ১৫টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনে নদ-নদীর পানি হ্রাস পেয়েছে।
বনা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে জলীয় বাষ্পবাহী মৌসুমি বায়ু দেশের আকাশে বিস্তার লাভ করায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই বৃষ্টিপাত আরো দুই দিন অব্যাহত থাকবে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টা এসব নদ-নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রেখেও পানির ¯্রােত সামলানো যাচ্ছে না। এতে ব্যারাজের উজান ও ভাটিতে তিনটি ইউনিয়নের ১১টি চরের বাড়ি ঘরে থৈ-থৈ করছে পানি। বিশেষ করে ডিমলা উপজেলা খালিশা চাপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর, ছোটখাতা, সতীঘাট টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চর খড়িবাড়ি, পূর্ব খড়িবাড়ি, টাবুর চর, পূর্ব টাবু, জিঞ্জিরপাড়া, একতাপাড়া, মুন্সিপাড়া এবং খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের কিসামতের চরে বাড়ি ঘরে থৈ-থৈ করছে হাঁটুপানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, ভারত গজলডোবা ব্যারেজের সবকটি গেট খুলে দিলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা প্লাবিত হয়ে যায়। তখন তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়ার পরেও পানির ¯্রােত সামলানো সম্ভব হয় না। এতে ব্যারাজের উজান-ভাটিতে নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যায়। বাড়ে মানুষের ভোগান্তি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে ঘাঘট-করতোয়া, তিস্তা-যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে প্লাবিত হওয়া এসব গ্রামের অনেকের বসতবাড়ির লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সেইসঙ্গে শত শত একর ফসলি জমি, পাট, পটোল, কাঁচামরিচ ও শাক-সবজির ক্ষেতসহ সদ্য রোপণকৃত বীজতলা তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। নি¤œাঞ্চল তলিয়ে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টা এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে করে এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় দফা বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী, রাজীবপুর ও সদর উপজেলার শতাধিক চর ও দ্বীপ চরের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। বন্যার্ত এলাকায় রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে পাট, সবজি, কলাসহ আমন বীজতলা। এসব এলাকার বেশিরভাগ নলকূপ পানিতে তলিয়ে থাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছে বন্যাকবলিতরা।
এদিকে নদনদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপচরের মানুষজন দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়লেও এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহায়তা পায়নি। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বলদিয়া গ্রামের মফিজন বেওয়া জানান, বাড়ির চারদিকে পানি উঠেছে। ঘরের ভিতর পানি ঢুকছে। কোথাও বের হওয়া যায় না। ছেলে-মেয়ে, গরু-ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গত বন্যায় কোনো সাহায্য পাইনি। এবারো কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ওসমান আলী জানান, নদীর পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় আর বাড়িতে থাকা সম্ভব হবে না। ছেলেমেয়ে, গরু-ছাগল নিয়ে উঁচু কোনো জায়গায় যেতে হবে। ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি জীবন-যাপন করছে। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে গত বন্যার চেয়ে আরো বড় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১শ মেট্রিক টন চাল ও ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে বিতরণ করা হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলামারী পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা নদীর পানি ষোলঘর পয়েন্ট দিয়ে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার সাত উপজেলা দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা ও সুনামগঞ্জ সদরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলায় রাস্তায় পানি উঠে যাওয়ায় সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে তাহিরপুরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮ দশমিক ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাপাউবো সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার গতকাল জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কুড়িগ্রামে নতুন করে বন্যা
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে কুড়িগ্রামে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বেড়েছে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও দুধকুমারে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
ফলে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেড় শতাধিক চর নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী রয়েছেন কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ^রী, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার অন্তত ২০ হাজার মানুষ। এসব চরের উঁচু ভিটা ছাড়া সব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে সবজি, পাট ও কলাসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত। যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে দিনমজুরদের কাজকর্ম। কয়েকশ’ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে রাস্তা ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে। পানির প্রবল তোড়ে চরাঞ্চলে ভেঙে গেছে প্রায় অর্ধশত ঘর-বাড়ি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা) ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১৮ সেন্টিমিটার, ধরলায় ৫৫ সেন্টমিটার, তিস্তায় ২১ সেন্টিমিটার ও দুধকুমারে ১৫ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে।
সুন্দরগঞ্জে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী : একজনের মৃত্যু
মোশাররফ হোসেন বুলু, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। গত কয়েক দিনের নদীভাঙনে এ পর্যন্ত ৪শ’ পরিবার বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে।
গত ৫ দিন ধরে একটানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ৬ ইউনিয়নের চরাঞ্চলসহ নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে ব্যাপক নদীভাঙন। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর পাটক্ষেত ও সবজিক্ষেত। পানিবন্দী মানুষ গবাদি পশু হাঁস-মুরগি নিয়ে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অনেকেই বাঁধে ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে অবর্ণনীয় অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, পানিবন্দী মানুষের তালিকা নেয়া হচ্ছে। এদিকে গত সোমবার লখিয়ারপাড়া গ্রামের ছাপান আলীর ছেলে আজগর আলী (৬০) বন্যার পানির সাথে মোকাবেলা করে অন্য চরে যেতে পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন