মোবায়েদুর রহমান : সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশে বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের যে ডাক দিয়েছেন সেটিকে কেন্দ্র করে রীতিমত একটি ইস্যুর জন্ম হয়েছে। সেই ইস্যুটি নিয়ে সরকার পক্ষ এবং সরকারবিরোধী পক্ষের মধ্যে রীতিমত তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো এই যে, সরকার পক্ষ একবার নয়, একাধিকবার বেগম জিয়ার ঐক্য প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির এক শ্রেণীর নেতা ঐক্যের গান গেয়েই চলেছেন। শুধু তাই নয়, সরকার পক্ষ এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বেগম জিয়ার ঐক্যের প্রস্তাব খুব রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও বিএনপির কোন কোন নেতা এবং বিএনপিপন্থী কোন কোন বুদ্ধিজীবী এখনো ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের কাছেই চিঠি দেয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছেন। বিএনপির এই ঐক্য প্রস্তাব নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মহলে দুর্বোধ্য বলে মনে হয়েছে।
কারণ যেদিন বেগম জিয়া এই ঐক্য প্রস্তাব দেন সেদিন তার ঠিক দুই ঘণ্টা পরেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম-মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন যে, যারা জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে তাদের সাথে কোন আলোচনা হবে না। এরপর আওয়ামী লীগের নেতারা ঐক্য গড়ার জন্য বিএনপির কাছে একের পর এক শর্ত দিতে থাকেন। প্রথম শর্তে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিএনপিকে সর্বাগ্রে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে। যখন বিএনপির একটি শ্রেণীর মধ্যে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩/৪ দিন আগে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। কাদের সাথে ঐক্য হয়েছে সে বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, যাদের সাথে ঐক্য হওয়া দরকার তাদের সাথে ইতোমধ্যেই ঐক্য হয়ে গেছে।
বিএনপি হতাশ
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বিএনপির আব্দুল্লাহ নোমান বলেছেন যে, বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে হতাশ হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির সাথে কোন আলোচনায় বসবে না। তারপরেও বিএনপি বিগত ২ বছর ধরে বারবার কেন আওয়ামী লীগের সাথে বসার জন্য আকুলতা প্রকাশ করছে, সেটি পর্যবেক্ষক মহলের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ ২০১৪ সালে বিএনপির হরতাল ও অবরোধ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে তারা একের পর এক সরকারের কাছে বৈঠক, সংলাপ, মধ্যবর্তী নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যুতে প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তারা প্রস্তাব দিল মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সেই প্রস্তাব আওয়ামী লীগ পত্র পাঠ নাকচ করে দেয়। আওয়ামী লীগ নাকচ করলে কি হবে, বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলেই যেতে থাকে।
সংলাপের প্রস্তাব
এরপর বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপের প্রস্তাব দেয়। তখন আওয়ামী লীগ বলে যে, দেশে কোন সংকট নেই। তাই বিএনপি বা ২০ দলের সাথে কোন সংলাপ অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন নেই। তারপরেও বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং সংলাপ প্রস্তাবের পুনারাবৃত্তি করতেই থাকে। বিগত ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন করার পর দেশে আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই আড়াই বছরে (হরতাল ও অবরোধের দিনগুলো বাদে) বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং সংলাপের কথা বলেই গেছে। এই বলাবলিতে তাদের কোন ক্লান্তি নেই। টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শোতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরীসহ একাধিক বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী বিএনপিকে কটাক্ষ করেছেন। বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অবশেষে বিএনপি এই দুটি পয়েন্টে চুপ মেরে যায়।
এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে, বিএনপি যদি সংলাপ বা মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় তাহলে এইভাবে আবেদন নিবেদন করে কোন ফল পাবে না। সরকার সংলাপেও বসবে না, নির্বাচনও দেবে না। এগুলো দেয়ার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। আর সেটি একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন বিএনপি হাজার হাজার মানুষ নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলতে পারবে।
বিদেশিদের দুয়ারে ধর্না
মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং সংলাপ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বিএনপির কথায় কর্ণপাত না করে যখন নির্বাচন না দেয়া বা সংলাপ না করার পয়েন্টে অবিচল থাকে তখন বিএনপি বিদেশিদের দুয়ারে ধর্না দেয়। তারা বিদেশিদের সংলাপ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়ে বলে। দেশি-বিদেশি মিডিয়ার রিপোর্ট পড়ে মনে হয় যে, বিদেশিরাও এ ব্যাপারে কনভিন্সড। তৎসত্ত্বেও বিদেশিরা যা করেন সেটি ছিল নেহায়েত লিপ সার্ভিস প্রদান। এর বাইরে বিদেশিরা কি করবে? জোরেসোরে চাপ দেবে? সেটিও সম্ভব নয়। কারণ আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পেছনে শিলা অটল পর্বতের ন্যায় দৃঢ় সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। সুতরাং শত আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের ডাল গলেনি।
এবার এসেছে ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে
গুলশান ম্যাসাকারকে কেন্দ্র করে বিএনপি আবার প্রস্তাব দেয়ার রাজনীতি শুরু করেছে। এবার তারা সন্ত্রাস দমন ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। কার সাথে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে? আওয়ামী লীগের সাথে? আগেই বলেছি যে, বেগম জিয়ার ঐক্য প্রস্তাব টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই মাহবুব-উল আলম হানিফ সেটি পত্রপাঠ বিদায় দিয়েছেন। প্রত্যাখ্যান এবং নাকচের রাজনীতিতে আওয়ামীগ যে এত প্রম্প্ট সেটি বিএনপির মাথায় কোন অবস্থাতেই ঢুকছে না। এবার এই ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির পলিটিক্যাল উইং যতনা আগ্রহী তার চেয়ে আরো আগ্রহী এবং তৎপর দেখা যাচ্ছে দুইজন নন পলিটিশিয়ানকে। এদের একজন হলেন বিএনপিরই বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ। আরেকজন হলেনÑ ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যিনি কোন দিক দিয়েই বিএনপির লোক নন। কিন্তু ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেই এবার এই ইস্যুতে বেশি ছোটা ছুটি করতে দেখা যাচ্ছে।
জামায়াত প্রশ্নে জাফরুল্লাহ
আগেই বলেছি যে, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির কেউ না। কিন্তু বিএনপির কি করা উচিৎ আর কি না করা উচিৎ সে ব্যাপারে তিনি অবলীলাক্রমে কথা বলে যাচ্ছেন। জঙ্গিবাদ রুখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ রুখতে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারেন। একে একে আলোচনায় না বসে সবাই মিলে আলোচনা করলে ভালো হবে। কারণ জঙ্গিবাদ রুখতে সবার বুদ্ধি নিতে হবে এবং সবার কথা শুনতে হবে। জাফরুল্লাহ বলেন, উনার (শেখ হাসিনার) বাবা (বঙ্গবন্ধু) এ পরিস্থিতিতে সবাইকে ডাকতেন, সবার সঙ্গে কথা বলতেন। প্রধানমন্ত্রীকেও তার বাবার মত কাজ করতে হবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরো বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতের পূর্ব পুরুষরা (অর্থাৎ নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান প্রমুখ) যে পাপ করেছেন তার জন্য জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে ক্ষমা চাইতে হবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করতে হবে জামায়াতকে।
জাফরুল্লাহর বক্তব্যের পর্যালোচনা
জাফরুল্লাহ বলেছেন, জঙ্গিবাদ রুখতে শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে তাতে শেখ হাসিনা তো ইতোমধ্যেই দায়িত্ব নিয়েছেন। গুলশান ম্যাসাকারের হত্যাকারীদের ধরার জন্য তিনি সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট নামিয়েছেন এবং ৫ জন জঙ্গিকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত ১৯ তারিখেও জাতীয় সংসদে তিনি বলেছেন যে কয়েকজন জঙ্গিকে এ্যারেস্ট করেই তিনি ক্ষান্ত হবেন না। এবার তিনি এর শেকড় উপড়ে ফেলবেন।
এই রকম পরিস্থিতে প্রধানমন্ত্রীর পিতা সকলকে ডাকতেন, জাফরুল্লাহর এই বক্তব্য সঠিক নয়। শেখ মুজিব ৬ দফা দেয়ার সময় কারো সাথে আলোচনা করেননি। তারপর ৭০ এর নির্বাচন পর্যন্ত সিপিবি, ন্যাপ মোজাফ্ফর বা ন্যাপ ভাসানী- কারো সাথেই পরামর্শ করেননি।
জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমা চাওয়া অথবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করার যেসব শর্ত জাফরুল্লাহ দিয়েছেন সেই সব শর্ত বেগম জিয়া জামায়াতকে দেবেন কিনা সেটা বিএনপির দলীয় বিষয়।
প্রফেসর এমাজউদ্দিন
প্রফেসর এমাজউদ্দিন বলেছেন যে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে জামায়াতকে সরে যেতে হবে। যদি তারা সরে না যায় তাহলে তাদেরকে সরিয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে জামায়াত তাদের কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির সিদ্ধান্ত কি হবে, সেটার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কি বসে আছে? নাকি তারা বসে থাকবে? গুলশান ম্যাসাকারের পর ২০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যা ভাল মনে করেছে সেটি করে যাচ্ছে। আমেরিকা ভারত প্রভৃতি দেশের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সবগুলোকে মাঠে নামিয়েছে। জামায়াতকে সরিয়ে দেয়া বা জামায়াতের সরে যাওয়া তো এখানে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। বিএনপি যে ঐক্য চায় সেই ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে গেলেই তো হয়। জামায়াতকে রাখা না রাখা তো তাদের ব্যাপার। জামায়াতের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটি হবে এক তরফা এবং তার দায় দায়িত্ব বিএনপিকেই নিতে হবে।
জামায়াতকে বাদ দিয়ে
অন্যদেরকে নেয়া
আওয়ামী লীগের মুখ থেকে নয়, বরং বিএনপি ঘরানার কারো কারো মুখ থেকে এবং জাফরুল্লাহদের মুখ থেকে প্রস্তাব এসেছে যে, জামায়াতকে বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব এবং কাদের সিদ্দিকীকে নেয়া হোক। আবার কেউ কেউ বলছেন, সিপিবি বা বাসদের মত বামপন্থীদেরকেও এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় নেয়া হোক। বিএনপি একটি স্বাধীন দল। তারা ওপরে বর্ণিত যেকোন সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে সরকারবিরোধী আন্দালনের সাফল্য নির্ভর করে রাজপথের শক্তির ওপর। কামাল হোসেন, আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী বা জাফরুল্লারা রাজপথের আন্দোলনে বিএনপিকে কতদূর সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবে সেটি বিএনপি নেতারা কতদূর ভেবেছেন, সেটা আমরা জানি না। সিপিবি আসলে আদর্শিকভাবে আওয়ামী ঘরানার। তাদের সাথে বিএনপির মিল খায় কিভাবে সেটি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বুঝতে অক্ষম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন