বৈশাখে কেউ কোনদিন শীত দেখেছে? বিগত কয়েক বছর গরমের সময় রমজান এলেও অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে মানুষ বিস্মিত ও মুগ্ধ। আল্লাহর কুদরতি ব্যবস্থায় এই তিরিশ দিনই আবহাওয়া থাকে অন্য কোন মেজাজে। প্রশান্তির বাতাবরণ, স্নিগ্ধ শীতলছায়া, মনে হয় রোজাদারদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমতের দৃষ্টি। এবার বৈশাখের কী আলাদা ভাব। আলাদা রূপ। এই রমজানের বরকত লাভ নিয়েই দুয়েকটি জরুরি কথা।
পবিত্র রমজান চলছে। জাকাত সদকা দান সাহায্য সহায়তা ফিতরা ইত্যাদি দেয়ার সুবর্ণ সময়। কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষের জীবন-জীবিকার নজিরবিহীন স্থবিরতার এ সঙ্কট মুহূর্তে আমাদের সবাইকে নিজের সাধ্য মতো অপরকে সহায়তা করে যেতে হবে।
আল্লাহ বলেন, তোমাদের সম্পদে ভিক্ষুক, সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। (আল কোরআন, আলে ইমরান ১৩৪) যারা তাদের অর্থ সম্পদ দান করে দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে ও গোপনে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের পালনকর্তা আল্লাহর কাছে। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো দুশ্চিন্তায়ও পতিত হবে না। ( আল বাকারাহ ২৭৪)
মানুষ সে যেমন সামর্থ্যই রাখুক, আল্লাহ তাকে দানে উৎসাহিত করেছেন। বলেছেন, যারা দান করে নিজের সুদিনে ও দুর্দিনে... (আল কোরআন, আয-যারিয়াত ১৯) এবার যেমন ফিতরার অর্থমূল্য নির্দেশ করা হয়েছে নিচে ৭০ টাকা, উপরে ২২০০ টাকা। যারা পারেন ২/৩/৪/৫ হাজার টাকা করে ফিতরা দিতে পারেন। ৭০ টাকা করেও পারেন। এটি হচ্ছে কম পরিমাণ থাকায় কোটি কোটি মানুষের ফিতরা দেয়ার সুবিধা। পাবেও কোটি কোটি অভাবী মানুষ। আর উপরের সিলিং ধরে লাখো লোকজন দিতে পারে ২/৪/৫/১০ হাজার টাকা করে, নিজের ও নিজের পোষ্যবর্গের পক্ষ থেকে।
জাকাত অগ্রিম যেমন দেয়া যায়, জাকাতের বাইরেও সাধারণ দান বা সদকা করা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। এমন দিনে গিফট হিসেবে দান করার সুযোগও প্রচুর। মানুষকে জাকাত ফিতরা বা দান-সদকা দিলে তা ভাঙিয়ে বলে দেয়া জরুরি নয়। বরং সৌজন্য বজায় রেখে গোপনে বা কৌশলে দেয়া উত্তম।
জাকাত বাবা মা ও তাদের উপর দিককার নারী পুরুষ মুরব্বি এবং নিজ সন্তান সন্ততি ও তাদের নিচের দিককার নারী পুরুষ সরাসরি প্রজন্ম ছাড়া সব আত্মীয় স্বজনকে দেয়া যায়। আত্মীয়, স্বজন, নিকট প্রতিবেশী, পাড়া প্রতিবেশী ও বিপদে পড়া মানুষ মাত্রই আপনার আমার সহানুভূতি পাবেন। মনে রাখতে হবে, দুনিয়া পুরোটাই ধোকা ছলনা মায়াজাল আর অর্থহীন ভোগবিলাস মাত্র। (আল কোরআন) কাজের জিনিস কেবল দানসামগ্রী, সঞ্চিত সওয়াব আর মানবতার কল্যাণে ব্যয়িত টাকা পয়সা, তা সে যত সামান্যই হোক।
আপনার আশপাশের পরিচিত ও সহায়তার উপযোগী সবার জন্য আপনি যত পারেন প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য গিফট হিসেবে বিলাতে থাকুন। যাদেরকে পারেন খোঁজ নিয়ে নিয়ে কর্জে হাসানা দিয়ে যান। মানে, যখন পারে তারা ফেরত দেবে, না পারলে দেবে না। আপনি দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর কাছে এসব বহুগুণ বেশি ও স্থায়ীভাবে প্রাপ্ত হবেন। অতএব আসুন, আল্লাহকে খুশি করার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাই আর দুদিনের এই মানবজীবন সার্থক করি।
দানের সৌন্দর্য্য ও মননশীলতা
একদিন এক ব্যক্তি ভিক্ষা চাইলে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. একজনকে দিয়ে সে ভিক্ষুকের জন্য কিছু দান পাঠিয়ে দিলেন। আরেক দিন একজন অভাবী মানুষ তার বাসায় এসে কিছু খেতে চাওয়ায় তিনি তাকে ঘরে বসতে বললেন। এক লোকের মারফত তাকে প্রায় একই ধরনের সাহায্য দান করলেন। তাকে কিছু খাবার দিলেন। তার এমন আচরণ দেখে লোকেরা জানতে চাইলো, দু’জন মানুষের সাথে তিনি কেন এমন আলাদা আচরণ করলেন। তখন হযরত মা আয়েশা রা. জবাবে বললেন, নবী করীম স. আমাদের বলেছেন, প্রতিটি মানুষের সাথে তার অবস্থা অনুপাতে আচরণ করবে। (আবু দাউদ, বাযযার, নবভী)
অন্য এক ঘটনায় দেখা গেছে, হযরত মা আয়েশা রা. এক সম্মানিত ব্যক্তির জন্য সাহায্য পাঠানোর সময় বাহককে বলে দিলেন, টাকা তার হাতে দিও না। এতে আমার প্রতিনিধি হিসেবে তোমার হাত উপরে থাকবে আর গ্রহীতা হওয়ায় তার হাত নিচে থাকবে, যা আমিও পছন্দ করি না। এটি তার জন্য দুঃখের বিষয় হতে পারে। তার সাথে দেখা করে, খোঁজ খবর নিয়ে একসময় তার শয্যাপাশে টাকাগুলো রেখে আসবে। আজ আমার সালাম পর্যন্ত তাকে মুখে বলো না, অভ্যাস মতো দোয়াও চাইবে না।
তিনি এমনিতেই এতটুকু বুঝবেন যে, আমি তোমাকে তাকে দেখতে, অবস্থা জানতে এবং সহায়তা পেশ করতে পাঠিয়েছি। এটা না জানলে তো তিনি যার তার সাহায্য নেবেন না আর এমনিতে গোপনে টাকা-পয়সা রেখে এলেও তা হাতে ধরবেন না। এমনই ছিলো ইসলামের সঠিক সহায়তা পদ্ধতি। নবী করীম স. বলেন, এমনভাবে দান করা যাতে ডান হাতে দান করলে নিজের বাম হাতটিও টের না পায়। (আরশের ছায়ার হাদীসাংশ, বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, মুসনাদ আহমদ)।
গোপনে ভালোবাসা ও আনন্দ বিনিময়
এক লোক প্রতিদিন এক বৃদ্ধার কাছ থেকে আপেল কিনে নিয়ে যেতো। আপেল কেনার পর লোকটি প্রতিদিনের মতো একটা আপেল বের করে ওই বৃদ্ধাকে বলতো, আপনার আপেলগুলো দেখে মনে হচ্ছে আজও পানসে হবে, এই নিন একটা খেয়ে দেখুন, মিষ্টি আপেল বিক্রি করতে পারেন না?
এই কথা বলে নিজের কেনা আপেল থেকে একটি আপেল বৃদ্ধার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধা আপেলটি কিছুটা খেয়ে যেই মাত্র বলে, কই মিষ্টিই তো। তখন লোকটি তার প্যাকেটটি নিয়ে চলে যায়। এভাবেই নিয়মিত এ কারবারটি চলে।
প্রতিদিনকার মতো, একবার লোকটির স্ত্রী তার সাথে ছিলো । হাঁটতে হাঁটতে স্ত্রী বললো, তুমি প্রতিদিন এই বুড়ি মার সাথে মিথ্যে বলো কেন? আমরা তো আপেলগুলো খেয়ে দেখি, বেশ ভালো এবং মিষ্টি। লোকটি তখন তার স্ত্রীকে বললো, আসলে আপেলগুলো মিষ্টি আমিও জানি। কিন্তু তুমি কি দেখ না কত কষ্টে বুড়ী মানুষটির পেটের খাবার জোটে। আমি না হয় প্রতিদিন মিথ্যা বলে নিজের ভাগের একটা আপেল তাকে দিয়ে দেই।
এদিকে আপেল বিক্রি করা বৃদ্ধা ওই লোকটাকে নির্দিষ্ট ওজনের চেয়ে কিছু আপেল বেশি দেন। তিনি পুত্রসম এ যুবকের ভালোবাসাটুকু হারাতে চান না। আবার তার কৌশলী দানটাও তিনি গ্রহণ করে নিজের হাতের কামাইয়ের পরিচ্ছন্নতা মøান করতে চান না। বৃদ্ধা মনে মনে হেসে বলেন, আমি জানি সে প্রতিদিন আমাকে মিথ্যা বলে একটা করে আপেল খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। সে মনে করেছে আমি তা বুঝি না। তাই তার প্রতি ভালোবাসায় এবং তার আদরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আমার ওজনের পাল্লাটাও তার কেনা আপেলের দিকে ঝুঁকিয়ে দেই। এটা সে ছেলেটি বুঝতে পারে না।
নবী করীম স. বলেন, সবচেয়ে উত্তম নেক আমল মুসলমানের মনে আনন্দ পৌঁছে দেয়া। তাকে ঋণমুক্ত করা, তার প্রয়োজন পূরণ করা বা জীবিকায় সহায়তা করা তার বিপদ দূর করার মাধ্যমে। (বোখারী ও মুসলিম)
আত্মসম্মান নষ্ট না করে সহায়তা
এক লোক ফলের দোকানে গেলেন ফল কিনতে। দোকানি তাকে আপেল আঙ্গুর মাল্টা আনার ইত্যাদির দাম বললো। তিনি দরাদরি করে কিছু ফল মেপে দিতে বললেন। একজন কর্মচারী তার জিনিস প্যাক করতে লাগলো। এরই মধ্যে এক মহিলা দুটি বাচ্চাসহ ফল কিনতে এলে দোকানি তাকে সব ফলের দাম কম কম করে বললো এবং মহিলাটি কিনতে চাওয়ায় তাড়াতাড়ি নিজ হাতে কয়েক রকম ফল মেপে দিতে লাগলো। প্রথম ক্রেতা ব্যাপারটি খেয়াল করে এরপর দেখলেন যে, মাপের মধ্যেও দোকানী তাকে একটু বেশি বেশি করে দিচ্ছে।
মহিলা টাকা দিয়ে চলে যাওয়ার পর প্রথম ক্রেতা এসবের কারণ জানতে চাইলেন। তখন দোকানি বললো, জনাব আপনি কিছু মনে করবেন না। এ ভদ্রমহিলা একজন আত্মমর্যাদাশালী মানুষ। আগে তাদের অবস্থা খুব ভালো ছিলো। বর্তমানে তিনি স্বামীহারা। এতিম বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে আছেন। কিন্তু কারো দয়া নিতে চান না। আমরা সবাই তাদের একথা জানি বলে তিনি কিছু কিনতে এলে দাম কমিয়ে বলি আর মাপেও যা পারি বাড়িয়ে দেই। তিনি না বুঝতে পেরেই আমাদের সহায়তা নিয়ে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলেন।
এই ক্রেতা এটি শুনে খুব খুশি হলেন। বললেন, আমার ফলগুলোর যে দাম আপনি প্রথম চেয়েছিলেন, তাই রাখুন। সামান্য যতটুকু আমি দরাদরি করে কমিয়ে ছিলাম, সেটুকু আপনার জন্য থাকুক। আপনার মতো পরোপকারী ব্যবসায়ী স্বাভাবিক লাভটুকু করতে পারলে এমন নেক কাজে লাগাতে পারবেন। দোকানি বললেন, আপনিও একজন হৃদয়বান ক্রেতা।
আসলে আমরা সবাই যদি আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিজের জায়গা থেকে একটু সচেষ্ট হই, তাহলে একে অপরকে নীরবে আনন্দ দিয়ে আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভ করতে সক্ষম হবো। নবী করীম স. এর হাদীসের মর্মার্থ। বিধবা এতিম অসহায় ও উপার্জনহারা লোকের জন্য যে কষ্ট ও উপার্জন করে তার সওয়াব হবে দিনভর রোজা রেখে, রাতভর নামাজে দাঁড়িয়ে থেকে এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধে সময় কাটানো ব্যক্তির মতো। (বোখারী ও মুসলিম, সহীহুল জামে ৫৭৭৩)
নবী করীম স. ঠিক দেড় হাজার বছর আগে বলে গিয়েছেন, অধিক ধন সম্পদ থাকলেই মানুষ ধনী হয় না। মানুষের মন ধনী হলেই মানুষ ধনী হয়। অভাববোধ ও লালসামুক্ত অন্তরই বিত্তশালী অন্তর। (বোখারী ৫৯৬৫)
ছোট দানও আল্লাহর কাছে হতে পারে অনেক বড়ো ও সমাদৃত
কনস্টান্টিনোপোল বিজয়ী মুসলিম মহাবীর সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ ইস্তাম্বুলে তার ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মাণ করাচ্ছিলেন। নিষেধ ছিলো কারো কোনো দান নেয়া যাবে না। একদিন গরমের সময় জনৈকা বৃদ্ধা শ্রমিকদের জন্য কিছু দই নিয়ে এলেন। নিষেধ থাকায় কেউ দই নেয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে দইগুলো বিলিয়ে বুড়ী চলে গেলেন। একজন শ্রমিক পিপাসার সময় জনসাধারণের সাথে মিশে এককাপ দই খেয়ে নেয়।
পরদিন সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ মসজিদের কাজ পরিদর্শনে এসে বললেন, বাইরের কোনো লোকের কিছুই মসজিদের জন্য ব্যবহার করা হবে না জানা সত্ত্বেও কেউ একজন গতকাল এক বুড়ি মার দেয়া দই খেয়েছে, সে লোকটি কে? আমি কোনো শাস্তি দেব না। আমাকে সত্যটি জানাও আর সামনে এসো। তখন সেই শ্রমিক ভয়ে ভয়ে সামনে এলো। বললো, তৃষ্ণার্ত ছিলাম আর বৃদ্ধার কাতর অনুরোধ ফেলতে পারিনি। অবশ্য আমাদের জন্য ঠা-া পানি শরবতের ব্যবস্থা ছিলো। আমার ভুল হয়ে গেছে।
সুলতান আল ফাতেহ হেসে বললেন, তুমি দই খেয়ে ভালোই করেছ। এখন থেকে মানুষ ভালোবেসে কিছু দিলে তোমরা নিতে পারো। মসজিদের কাজেও যারা চায় শরিক হতে পারে। কারণ, আমার এ সিদ্ধান্ত মনে হয় সঠিক ছিল না। গতরাতে স্বপ্নে দেখলাম আমার পূর্ণ মসজিদটি এক পাল্লায় রাখা হয়েছে আরেক পাল্লায় এককাপ দই। দইয়ের পাল্লাটি মসজিদের পাল্লার সমান সমান। আমাকে বলা হলো, তোমার একজন লোক এই বুড়ি মার দানের দই রাখায় পাল্লাটি সমান হল। না হলে মসজিদটি পাল্লায় তোলাই হত না।
নবী করীম স. বলেছেন, একটি খেজুর দান করে হলেও তোমরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর। (মুনতাখাব সিহাহ) বলেছেন, আমার নৈকট্যশীল অগ্রগামী সাহাবিদের একটু সামান্য দানের সমপরিমাণ সওয়াব পরবর্তীরা দুনিয়া ভরা স্বর্ণ রৌপ্য দিয়েও অর্জন করতে পারবে না। এসবই নিষ্ঠা, প্রেম ও নিখুঁত আবেগের ফল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন