শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না

আবারও খুলনায় ১৫পিস বাঘের হাড়সহ ২ পাচারকারী গ্রেফতার

প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : সুন্দরবনের বাঘের ১৫ পিস হাড়সহ দুই পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৬। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনাস্থ র‌্যাব-৬ এর সদর দপ্তরে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানির কমান্ডার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান। গত বুধবার সন্ধ্যায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বেতবুনিয়া বাজারসংলগ্ন ফেরিঘাট থেকে বাঘের হাড়সহ পাচারকারীদের গ্রেফতার করে র‌্যাবের ছদ্মবেশী ক্রেতা দল। কিছুদিন পর পর খুলনাঞ্চল থেকে বাঘের চামড়া ও হাড় উদ্ধার করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এভাবে ক্রমেই বাঘ শূন্য হতে চলেছে সুন্দরবন। তাহলে কি বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুরক্ষায় কোন পদক্ষেপই কাজে আসছে না?
প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানির কমান্ডার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, আটককৃতরা হল খুলনার কয়রা উপজেলার ভাগবা গ্রামের মৃত ওয়াজেদ গাজীর ছেলে গোলাম রসুল (৪৫) ও পাইকগাছা উপজেলার বেতবুনিয়া গ্রামের মোক্তার গাজীর ছেলে খলিল গাজী (৩২)। হাড় কেনার কথা বলে ক্রেতা সেজে পাচারকারীদের সাথে র‌্যাবের সোর্স যোগাযোগ করে। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের ১৫ পিস হাড় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রির চুক্তি হয়। সে মোতাবেক পাচারকারীরা একটি ব্যাগে হাড় নিয়ে আসার পথে পাইকগাছা উপজেলার বেতবুনিয়া বাজারসংলগ্ন ফেরিঘাট থেকে তাদের হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধারকৃত হাড়গুলোর ওজন ২ কেজি ১০০ গ্রাম।
সূত্রমতে, ২০০৪ সালে পায়ের ছাপ পদ্ধতির জরিপে সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ পাওয়া গেলেও গত বছরের ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির জরিপের ফল অনুযায়ী, বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। চোরাশিকারিদের কারণেই দিন দিন বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাঘ হত্যা বন্ধ এবং বন ও জলদস্যু দমনে সরকার টাস্কফোর্স ও ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট গঠন করা হয়েছিল।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৭ আগস্ট পুলিশ খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাঘের ৬৯টি হাড়সহ দুজনকে আটক করে। ওই বছরের ৯ আগস্ট খুলনার কয়রার চরামুখা এলাকা থেকে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে পুলিশ। পরে অভিযানে সুন্দরবনে শিকারিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন বাঘ শিকারি নিহত হয়। এই বাহিনীর সদস্য কয়রার চ-িপুর গ্রামের কিশোর ঢালীর বাড়ি থেকে গেল বছরের ২৪ আগস্ট দু’টি বাঘের হাড় উদ্ধার করা হয়। এরপর ২৬ আগস্ট খুলনা শহরের পূর্ব বানিয়াখামার এলাকা থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব-৮। গত সেপ্টেম্বরেও খুলনার মুন্সিপাড়া এলাকা থেকে দু’টি বাঘের চামড়াসহ দু’জনকে আটক করা হয়েছিল।
নয়নাভিরাম সুন্দরবনে শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাঘ ও হরিণ। র‌্যাব-৬ (খুলনা) ও র‌্যাব-৮ (বরিশাল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর সাতক্ষীরা থেকে বাঘের দু’টি চামড়াসহ ৬জনকে আটক করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থেকে বাঘের একটি চামড়াসহ ৩ জনকে আটক করে র‌্যাব। একই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনার পাথরঘাটা থেকে হরিণের ৩৬টি চামড়াসহ দু’জন এবং বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে হরিণের একটি চামড়াসহ আটক হয় একজন। গেল বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা থেকে বাঘের চামড়াসহ আটক করা হয় একজনকে। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়া উপজেলার ইকড়ি বাজার থেকে বাঘের একটি চামড়া ও হরিণের ১৪টি চামড়াসহ দু’জনকে আটক করে র‌্যাব। ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা এলাকা থেকে বাঘের একটি এবং হরিণের চারটি চামড়াসহ তিনজনকে আটক করা হয়। র‌্যাব-পুলিশের অভিযান যেমন চলছে; তেমনি চলছে চোরাশিকারী ও পাচারকারীদের অপতৎপরতাও।
জরিপে দেখা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ বিচরণ করে। এদের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি; সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এবং খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী। এই তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে ওই জরিপটি চালানো হয়েছে। এরমধ্যে বাগেরহাটে ১৭টি, সাতক্ষীরায় ১৩টি ও খুলনায় আটটি বাঘের ছবি ধারণ করা হয়েছে। বাঘের ছবি তোলার জন্য বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ৭১টি করে এবং খুলনায় ১৩২টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এই তিনটি এলাকার মধ্যে বাগেরহাটে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ৩ দশমিক ৭টি, সাতক্ষীরায় ২ দশমিক ৭৭ ও খুলনায় এক দশমিক শূন্য ৮টি করে গড়ে বাঘ বিচরণ করতে দেখা গিয়েছিল।
সূত্রে জানা যায়, চোরাশিকারিরা আগে বাঘের বিচরণক্ষেত্র ‘রেকি’ করে। পরে গুলি চালিয়ে বাঘ হত্যা করে। এরপর নিরাপদ স্থানে নিয়ে চামড়া, হাড়গোড়, দাঁত আলাদা করে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে। পরে চোরাকারবারীদের চাহিদা মতো বিক্রি করে দেয় বাঘের নখ থেকে মাথার খুলি পর্যন্ত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, চায়নায় বাঘের হাড়গোড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব চোরাকারবারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। চোরাশিকারীরা এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় এই অপকর্ম করে। মৃত একটি বাঘ দুই কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে-মধ্যে বাঘের চামড়া ও হাড় উদ্ধার করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাঘ হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর সেকেলে থ্রী নট থ্রী রাইফেল দিয়ে বনরক্ষীরা বাঘ হত্যাকারীদের মোকাবিলা করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, একের পর এক বাঘ ও হরিণ শিকার হলেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বনবিভাগ। বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা এই কাজে সহযোগিতা করে থাকেন।
উদ্বেগ প্রকাশ করে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘হাড়-চামড়া উদ্ধার হচ্ছে। তবে বাঘ ও হরিণ শিকারের সব ঘটনা প্রশাসনের নজরে আসে না। চামড়া বহনকারীরা ধরা পড়লেও শিকারি এবং বন্যপ্রাণীর চামড়া ক্রেতা এবং মূল শিকারীদের বেশিরভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।’
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক জহিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুন্দরবনে টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া শিকারি ও বনদস্যুদের গ্রেফতারে বনবিভাগ, র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে।
র‌্যাব-৬ পরিচালক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, কোন পদক্ষেপ কাজে আসছে না; কথাটা ঠিক নয়। দস্যু ও চোরাশিকারী মুক্ত সুন্দরবন সুরক্ষায় র‌্যাব বদ্ধপরিকর। একেপর পর সফল অভিযানই তার প্রমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন