ইনকিলাব ডেস্ক : বৃহত্তর রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ ও গৃহপালিত পশু-পাখি। পানিবন্দি অবস্থায় তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার উপরে
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা : দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ২২ ও ধরলার পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ২৪ ঘন্টায় (বুধবার ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা) ব্রহ্মপুত্র নদে ৩ সেন্টিমিটার, ধরলায় ১৩, তিস্তায় ১৫ ও দুধকুমারে ৪ সেন্টমিটার পানি বেড়েছে। এ দিকে দুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে দিনমজুরদের কাজ-কর্ম। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, বন্যা কবলিত ৮৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক স্কুলে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বাকীগুলো কোনমতে চালু রয়েছে। নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ১০টি স্কুল, বেশ কিছু ঘর-বাড়ি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের অববাহিকার ৩০টি ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক চর প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে হাতিয়ার ৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া গুঁজিমারী গ্রামে তীব্র ভাঙনে ৭০টি পরিবার ও একটি স্কুল নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো: আব্দুল মোত্তালিব জানান, বন্যা কবলিতদের জন্য ১০০ মে. টন চাল ও ৪ লাখ টাকা মজুদ রাখা আছে। প্রয়োজন হলে তা বরাদ্দ দেয়া হবে।
গাইবান্ধায় পানি বৃদ্ধি
গাইবান্ধা‘ জেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শুধু ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ১২ ঘন্টায় বেড়েছে ৫ সে.মি.। তবে এখনও নদীগুলোর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার নদী তীরবর্তী চারটি উপজেলার চরাঞ্চলের ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কক্ষে পানি ওঠায় অঘোষিতভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১২টি পয়েন্টে স্রোতের তোড় বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েছে। ওইসব এলাকার ৬ হাজার পরিবারের বসতবাড়িতে পানি ওঠায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে বিঘিœত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিরামহীন বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে বন্যা কবলিত এলাকা জন দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে।
সিরাজগঞ্জে পানিবন্দি হাজারো মানুষ
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা ঃ
যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার চরাঞ্চলের ২৪টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। এর মধ্যে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষগুলো দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে। অপরদিকে, পানি বাড়ার সাথে সাথে চৌহালীর এনায়েতপুরে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে জানা যায়, জেলার ৮৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৪টি ইউনিয়ন মধ্য যমুনায় চরাঞ্চলে অবস্থিত। পানি বাড়ার সাথে এসব অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ফসলী জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বসতবাড়ী ও চারপাশে পানি ওঠায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট। অধিকাংশ স্কুলে পানি ওঠায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় বিঘœ ঘটছে। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে যাতায়াতে কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে নৌকাযোগে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
সয়াশেখা স্কুলের ৫ম শ্রেনীর সুমন জানান, বড় কয়ড়া থেকে সয়াশেখা নৌকাযোগে স্কুলে আসতে হয়েছে। অনেক সময় বৃষ্টি নামলে বই খাতা ভিজে যায়। তারপরেও কষ্ট করে স্কুল এসেছি। এছাড়াও পানি বাড়ার সাথে সাথে চৌহালীর উপজেলার এনায়েতপুরে নদীর তীরবর্তী বামন গ্রামে ভাঙ্গন শুর” হয়েছে। গত কয়েকদিনের প্রায় শতাধিক বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
কাওয়াকোলা ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম জানান, ৭নং ওয়ার্ডে বর্নি, বড় কয়ড়া ও ছোট কয়ড়া তিনটি গ্রামই বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে যাতায়াত অসাধ্য হয়ে পড়েছে। দরিদ্র এসব মানুষের নৌকায় নেই। এ অবস্থায় মানুষগুলো দুর্বিসহভাবে জীবনযাপন করছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান ইমাম জানান, গত ১২ ঘন্টায় ৫ সে.মি পানি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১২.৯৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখনও বিপদসীমার ৪১ সে.মি. নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা : অনবরত বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডুবে গেছে জেলার নিম্নাঞ্চল। সব কয়টি নদীর পানি উপচিয়ে এখন মানুষের বাসাবাড়ীতে প্রবেশ করছে। সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর, ষোলঘর কাজীর পয়েন্ট, সাহেব বাড়ীর ঘাট এলাকাসহ কয়েকটি সড়কে পানি ওঠেছে। বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢল নামা অব্যাহত থাকায় অনেকেই বন্যার আশংকা করছেন।
সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেল ৩ টায় বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এসময় সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ ষোলঘর পয়েন্টে পাউবো’র উন্নয়ন বোডের্র মিটারে পানির উচ্চতা ছিল ৯ দশকি ১৫ সেন্টিমিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার প্রায় আড়াইশতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে । জেলা সদরের সঙ্গে দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার আন্ত:সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলার সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ এ ৫টি উপজেলার এক শত ৮০ হেক্টর রূপা আমন বীজতলা, আউশ ধান ও সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাগেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাঠানো তালিকা ও চাহিদা অনুয়াযী তাহিরপুর উপজেলায় নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৫ টন চাল, দোয়ারাবাজার উপজেলায় নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৫ টন চাল, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় নগদ ২৫ হাজার টাকা ও ৫ টন চাল জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ছাতক ও দোয়ারাবাজারে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
ছাতক সংবাদদাতাঃ
সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী দু’টি উপজেলা ছাতক ও দোয়ারাবাজার। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কয়েকটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সদ্য রোপা আমন ও বীজতলা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা, লক্ষীপুর, বাংলাবাজার, মান্নারগাঁও, বগুলাবাজার, নরসিংপুর, দোয়ারাবাজার সদরসহ ৯টি ইউনিয়ন ও ছাতক পৌরসভাসহ উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর, নোয়ারাই, কালার”কা, ছাতক সদর, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও, উত্তর খুরমা, দক্ষিণ খুরমা, দোলারবাজার, ছৈলা-আফজালাবাদ, চরমহল্লা, জাউয়াবাজার, ভাতগাঁও, সিংচাপইড়সহ ১৩টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের মানুষ। পাহাড়ি ঢলে দু’উপজেলার সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন সুরমা, লক্ষীপুর, বাংলাবাজার, বগুলাবাজার, নরসিংপুর, ইসলামপুর ও নোয়ারাই ইউনিয়ন। রেকর্ড পরিমান বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদরের সাথে দোয়ারাবাজর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের যোগাযোগের প্রধান সড়কগুলোর বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় এবং বন্যার পানিতে নিম্ন এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কয়েকদিনের টানা বর্ষনে দোয়ারাবাজারের খাসিয়ামারা, চিলাই, চেলা, মরাচেলা ও চলতি নদী, ছাতক উপজেলার সুরমা, পিয়াইন, ধলাই, চেলা, মরাচেলাসহ সব ক’টি পাহাড়ি নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। পাথর আমদানি বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০সহস্রাধিক শ্রমিক।
দোয়ারাবাজার-নৈনগাঁও-ছাতক সড়কের নৈনগাঁওয়ে অবস্থিত দু’টি ব্রীজের এপ্রোচ ভেঙ্গে যাওয়ায় দোয়ারাবাজারের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নব নির্মিত ব্রিজগুলোর এপ্রোচে মাঠি না দেয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুজ্জামান জানান, বন্যায় উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষয়-ক্ষতির তালিকা করছেন। পূর্নাঙ্গ তালিকা সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরন করা হবে। দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত রাবারড্যাম সড়কসহ সুরমা ইউনিয়নের পানিবন্দি এলাকা এলজিইডির কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন