শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঝুঁকির মধ্যেই উঠছে লকডাউন

জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়বে: আইইডিসিআর

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২০, ১২:৪৯ এএম

জুলাইয়ের শেষে সহনীয় পর্যায়ে আসবে


 প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না


করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। তবে বিশ্বব্যাপি করোনার সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আস্তে আস্তে নামলেও বাংলাদেশে কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণ। বিশ্বের সর্বোচ্চ সংক্রমণপ্রবন দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ওই সব দেশ ৩৮ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণে পৌঁছে। এরপর থেকে সংক্রমণের হার কমতে থাকে। কিন্তু দেশে প্রথম শনাক্ত ৮ মার্চ থেকে গতকাল ৮২তম দিন পার করলো। এখনো প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। গতকালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে রেকর্ড করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ২৯ জন। এদিন মারা গেছেন ১৫ জন। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৫৫৯। যদিও করোনার নমুনা পরীক্ষার হার এখনও ১০ হাজারের কাছাকাছি বা কিছু বেশি। আর এ কারণে দেশে করোনার সঠিক চিত্র উঠে আসছেনা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জনসংখ্যা অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষা এখনও কম। যা বাড়ানো দরকার। ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা দরকার।

অন্যথায় সঠিক চিত্র পাওয়া কঠিন। অপরদিকে ঈদ কেন্দ্রিক গ্রাম থেকে শহরে আগে শহর থেকে গ্রামে মানুষের বিচরণ বাড়ায় আগামী ২ সপ্তাহ করোনার সংক্রমণ বাড়বে। এর আগেও লকডাউন শিথিল করে গার্মেন্টস, হাট-বাজার ও মসজিদ খুলে দেওয়াসহ একের পর এক ভুলে সংক্রমণ তো কমেইনি বরং ঊর্ধ্বমুখী। তাই দেশে করোনা সংক্রমণের ভবিষ্যত কি হবে সে ভাবনায় বিপাকে পড়ে যান বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন সময়ের ভুল সিদ্ধান্তে হিসাবের সব চিত্রে পরিবর্তন আসে। পাশাপাশি আগামী ১ জুন থেকে উঠছে লকডাউন। মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। এ জন্য স্বাভাবিকভাবে বাড়বে সংক্রমণ। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই ভয়াবহ চিত্র সামনে আসবে। জুন মাস সেক্ষেত্রে রীতিমতো চিন্তার কারণ। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী এখনও সংক্রমণের ঝুঁকিতে পুরো দেশ। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ইতোমধ্যে সতর্কতা দিয়েছে, যে সব দেশ লকডাউন তুলবে তাদের সামনে করোনা ভয়াবহ আকার নিয়েই হাজির হবে। আর তাই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে থাকবে বলে ধারণা করছে আইইডিসিআর। তারপর ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার কমার সম্ভাবনা রয়েছে। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ নামতে পারে সহনীয় পর্যায়ে। তবে জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলছে, সংক্রমণের শীর্ষবিন্দুতে এখনও পৌঁছেনি দেশ। তাই জুনের প্রথম দুই-তিন সপ্তাহ কড়াকড়িভাবে বিধি-নিষেধ নিশ্চিত করা জরুরি।

বিশেষজ্ঞদের করা ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণের (প্রজেকশন বা পূর্বাভাস) তথ্য বলছে, ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ থেকে ৫০ হাজার মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন। মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ। এ পর্যন্ত এই পূর্বাভাসের কাছাকাছি দেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি। তাই শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।

আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, প্রথমত সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখীর এই সময়ে সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি আরও বাড়বে। আরও সংক্রমণের আশঙ্কা আছে। জরুরি প্রয়োজনের পরিসর আরও বাড়ানো যেত। এখন সরকার আত্মসামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে খুলছে কি না, সেটি বলা যাচ্ছে না। তবে এখন যেটা করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, সেটি কঠোরভাবে দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না, সেটি অফিসের ভেতরে এবং বাইরে থেকে তদারক করা দরকার।

সূত্র মতে, প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার ভয়াবহতা। বাংলাদেশের সবকটি প্রশাসনিক বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় করোনা সংক্রামিত রোগীর সন্ধান মিলেছে। সর্বাধিক সংক্রমণের কেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা যেভাবে সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে ঈদের সময় ঢাকা থেকে দূরবর্তী মফস্বল ও গ্রামে যাওয়ার ভিড় ছিল তাতে সংক্রমণ প্রবল আকার নিতে চলেছে। এর মধ্যেই গত বুধবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানালেন, সাধারণ ছুটি আর বাড়ছে না। আর এ ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই আগামী ৩১ মে থেকে দেশের চিত্র আগের মতোই হযে যাচ্ছে।

সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর’র প্রাথমিক প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু একের পর এক ভুলে সংক্রমণ তো কমেইনি বরং ঊর্ধ্বমুখী। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, হঠাৎ করে বলা হলো অফিস, গার্মেন্টস খুলে দেয়া হবে সবাই ঢাকা চলে আসো। তখন একদল লোক ঢাকায় চলে আসলো এবং পরদিন বেতন দিয়ে বলা হলো তোমরা বাড়ি চলে যাও। এভাবেই সারাদেশে ছড়িয়েছে করোনা। এরপর মার্কেট খুলে দিয়ে আরও ঝুঁকি বাড়ানো হলো।

জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, একটি ফেরির মধ্যে গাদাগাদি করে লোকজন বাড়ি গেল। এদের মধ্যে অনেকে উপসর্গ ছাড়াই কোভিড পজিটিভ ছিল, যারা গ্রামে গিয়ে সবার সাথে মিশেছে। এর ফলে এটি খুব দ্রæতই গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে টানা ছেষট্টি দিনের সাধারণ ছুটি শেষ হচ্ছে ত্রিশে মে। পরদিন খুলছে অফিস-আদালত। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সংক্রমণ নিয়ে নতুন আরেকটি প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে আইইডিসিআর। সে-অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষ দিকে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে সংক্রমণ।

ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, আমাদের হিসেব মতে জুনের ১৫ তারিখ পর্যন্ত এখন যেমন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে তেমনই থাকবে। এটি সহজে স্বাভাবিক হবে না, তবে জুলাইয়ের শেষের দিকে সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। অবশ্য জাতীয় টেকিনিক্যাল পরামর্শক কমিটি বলছে, সংক্রমণের শীর্ষবিন্দুর দেখা মেলেনি এখনও। তাই জুনে কড়াকড়িভাবে বিধি-নিষেধ নিশ্চিতের বিকল্প নেই। তবে সংক্রমণ ঠেকাতে বিধি-নিষেধ নিশ্চিত করার ওপরই নির্ভর করে যথাযথ প্রক্ষেপণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, আক্রান্তের সংখ্যা কেবল এই ধারণাই দিচ্ছে যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

প্রকৃত চিত্র আসছে না
বিশ্বব্যাপি করোনার সংক্রমণের চিত্র হিসাব করলে দেখা যায়, অধিকাংশ দেশই ৩৫ থেকে ৭৫ তম দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ থেকে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। অথচ দেশে গতকাল ছিল সংক্রমণ শনাক্তের পর ৮৩ তম দিন। কিন্তু এখনো করোনার গতিবিধি বুঝতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক মানুষ রয়েছে যাদের শরীরে ভাইরাস থাকলেও উপসর্গ নেই। কিন্তু পরীক্ষা করার পর তিনি চিহ্নিত হচ্ছেন ভাইরাসবহসকারী হিসেবে। তিনি জানান, অনেক অসুস্থ মানুষ রয়েছেন যাদের পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তারা পরীক্ষা করাতে পারছেন না, কারণ পরীক্ষা করানোর মতো সুযোগ নেই।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি প্রয়োজনীয় কাজের পরিসর আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলে বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়বে। তবে যেহেতু খুলেই দেওয়া হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। এগুলো ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা অফিসের ভেতরে-বাইরে থেকে তদারক করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন