হাসান সোহেল : বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করতে উৎপাদনমুখী ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আজ ঘোষণা করা হচ্ছে অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের প্রথম মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জিপিডি প্রবৃদ্ধি অর্জনকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এক শতাংশের বেশি বাড়ানো হচ্ছে। পুঁজিবাজারে স্বস্তি, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে আস্থা ও উৎসাহ যোগানোর ঘোষণা থাকছে এতে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধের এ মুদ্রানীতি গভর্নর ফজলে কবির আজ বেলা ১১টায় ঘোষণা করবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত মার্চে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই হবে ফজলে কবিরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা। এর আগে সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি (২০১৫-১৬) অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিলেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
নতুন মুদ্রানীতি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেন, বিনিয়োগবান্ধব, প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও লক্ষ্য রাখা হবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, গতানুগতিক ধারায় এবারও মুদ্রানীতিকে সঙ্কোচনশীল বা সম্প্রসারণমুখী কোনটাই বলা হবে না। বেসরকারি ও উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ গতিশীল করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। মূলতঃ মুদ্রানীতির ভঙ্গি হবে সময়োপযোগী।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মুদ্রানীতি সঙ্কোচনমুখী না হয়ে সঙ্কুলানমুখী হওয়া দরকার। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরও বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের প্রবৃদ্ধি যেহেতু বেসরকারি খাতনির্ভর, তাই উদ্যোক্তাদের একধরনের বার্তা দিতে হবে। পাশাপাশি শুধু বড় বড় গ্রাহকের দিকে না ছুটে ব্যাংকগুলোকে ছোট ও মধ্যম মানের উদ্যোগে অর্থায়ন করতে হবে; তাহলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। আমাদের সমতাভিত্তিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে শুধু নির্দেশনা না দিয়ে তদারকি বাড়াতে হবে। আমাদের যে অর্জনগুলো আছে, তা সুসংহত করতে হবে। যে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো আসছে, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে, এসবের দিকে নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি সেবাগুলো যেন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। তাই বাজেটের সাথে সমন্বয় রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়াতে ঋণের সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হবে নয়া মুদ্রানীতিতে। ঋণের চাহিদা সৃষ্টিতে এসএমইর মতো আরও কিছু খাতকে এবার বেছে নেয়া হবে। এবারের বাজেটে মোট দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। ফলে এবারের মুদ্রানীতিতে এর প্রতিফলন আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ জোগানের প্রাক্কলন বাড়ানো হলেও ব্যাপক মুদ্রা জোগানের লক্ষ্যমাত্রা একই রকম থাকছে। গত মুদ্রানীতিতে জুন নাগাদ বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে এরই মধ্যে গত মে পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। জুনে এটি আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ১৬ শতাংশের উপরে ধরা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারী মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, এখন দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণে সুদহার কম থাকার কারণে উদ্যোক্তারা ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। অনেক নতুন উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শুরু করেছেন। আবার পুরনো অনেকে ঋণসীমা বৃদ্ধি করেছেন। এ কারণেই ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মুদ্রানীতির ভঙ্গি পরিবর্তনের তেমন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী জমার হারেও পরিবর্তন প্রয়োজন নেই। মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জায়গা থাকতে হবে। বেসরকারি খাতের ঋণ তো লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারছে না। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তার ব্যবস্থাপনা কী হবে, তাও ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব রয়েছে। এসব দুর্বলতা রোধে পরবর্তী ছয় মাস কী পদক্ষেপ থাকবে, তার ঘোষণাও থাকা প্রয়োজন।
গত মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার জোগানের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বিপরীতে মে নাগাদ অর্জিত হয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এদিকে সরকার মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ ধরলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে সীমিত রেখে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা আগের অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
তবে চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুনে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। গত মাসে (জুন) পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আগের মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মূলত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মানুষ বেশি কেনাকাটা করায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করছে সরকার।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে। ছয় মাস অন্তর এই মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই মাসে এবং অন্যটি জানুয়ারি মাসে ঘোষণা করা হয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন