শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণা

প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) জন্য কিছুটা সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণের যোগান বৃদ্ধির ঘোষণা এলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সতর্কতার কথাও বলা হয়েছে। বিশেষ করে ঋণপ্রবাহ যাতে অনুৎপাদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যবহার না হয় সেজন্য নিবিড় তদারকি করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আগামী ছয় মাসের এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। তিনি এ মুদ্রানীতিকে সতর্ক ও সংকুলানমুখী বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গভর্নরের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ডেপুটি গর্ভনর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান, এসকে সুর চৌধুরী ও চেঞ্জ ম্যানেজম্যান্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রেখে প্রতি ছয় মাসের জন্য আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকার প্রক্ষেপিত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারি খাতে ঋণের যোগান বাড়ার ঘোষণা এসেছে। গেল মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ যোগানের লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের এই যোগান ১৬ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীতের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত তা ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশে সীমিত রাখা হবে। ব্যাংক ঋণের চাহিদা না থাকায় নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের যোগান ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত তা বেড়ে ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ উন্নীতের আশা করা হয়েছে। সব মিলে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ (ডমেসটিক ক্রেডিট) প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৪ শতাংশে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের এই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করা গেলে তা বাজেটে ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ফজলে কবির। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির এই মাত্রা সরকার প্রক্ষেপিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যথেস্ট বলে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে জানান গভর্নর ফজলে কবির। তবে অভ্যন্তরীণ এই ঋণ প্রবাহ অনুৎপাদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যবহার না হয় সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার কথাও জানান গভর্নর। তিনি বলেন, এই ঋণ যাতে অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি চাহিদার জন্য উৎপাদনের প্রকৃত প্রয়োজনে সদ্ব্যবহার হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় নজরদারি থাকবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতে ঋণ প্রবাহের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকল্পে এ খাতেও নজরদারি অব্যাহত থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর মাঠ পর্যায়ে অর্থায়ন সাশ্রয়ী সুদে হবার বিষয়ে নজরদারি কঠোরতর করা হবে।
ঋণের সুদ হার কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণকেই প্রধান বাধা বলেও মন্তব্য করেন ফজলে কবির। তিনি বলেন, প্রায় সময়ই ব্যবসায়ীরা ঋণ সুদ হার কমানোর দাবি তুলেন। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋণ বাজারে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ ঋণ পরিশোধে শৃঙ্খলা থাকে না। ঋণ পরিশোধে শৃঙ্খলার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে পারলেই ঋণের সুদ হার কার্যকরভাবে কমানো সম্ভব। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সক্রিয় হওয়ার জন্য ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গভর্নর।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের কার্যক্রমের সহায়তার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি পরিমিত ও স্থিতিশীল রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংযত, সংকুলানমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব মুদ্রা ও অর্থায়ন নীতির ধারাবাহিকতা নতুন মুদ্রানীতিতেও বজায় থাকবে। এককথায় নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমাকে কি বলছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এটাকে বলব সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী। এদিকে, নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াবে ১৪ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
শীর্ষ খেলাপিদের নাম প্রকাশের চিন্তা-ভাবনা নেই : চীনের সাংহাই মডেলের মতো আমাদের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ খেলাপিদের নামের তালিকা প্রকাশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ ২০ জন করে ঋণ খেলাপির নাম প্রতেক্যটি ব্যাংকের কাছে আছে। অন্যান্য ব্যাংকে এত বড় ঋণ খেলাপি নেই বা এটা হওয়ারও খুব সম্ভাবনা নেই। আর চীনের সাংহাই মডেলে আমরা এখনি যেতে চাচ্ছি না। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে দুর্নীতি কিছু আছে। এটা কমন নলেজ। যখনই আমরা অভিযোগ পাবো। কাগজপত্র সেটা সিরিয়াসলি টেক আপ করবো এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন থেকে আরও সিরিয়াসলি টেকআপ করা হবে। এটি আমাদের গভর্নেন্সের একটি অংশ।
রিজার্ভের পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা : ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের পুরোটাই ফেরত আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। ফজলে কবির বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের তরফ থেকে যা যা করার করেছি। অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আমরা মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল সিস্টেম ঠিক করেছি। সেই অনুয়ায়ী তারা ফর ফিউশন অব কেস করে পৌঁছে যাচ্ছে। ফিলিপাইনের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল আমাদের আন্তরিকভাবে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিনাসও আমাদের সহযোগিতা করেছে। আমি সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিন্সের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়াও ফিলিপিন্সের অ্যাম্বাসেডর জন গোমেজ তিনি সমস্ত বিষয় কো-অর্ডিনেট করছে। তিনি বলেন, আরও অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় সেদেশের এন্টি মানি লন্ডারিং ফর ফিউচার কেস করেছে। তাদের যে অ্যাসেট ফ্রিজ করেছে, জব্দ করেছে, সেগুলো থেকে তাদের মাধ্যমে আমরা আশা করছি আরও অর্থ আসবে। বাকি অর্থের জন্য সেন্ট্রাল অব ফিলিপাইন্স ব্যাপকভাবে তদন্ত করছে, এ তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আমরা আশা করছি তদন্ত আমাদের পক্ষে আসবে। তার ভিত্তিতে সেন্ট্রাল ব্যাংক ফিলিপাইন্স বা এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল তাদের আদালতে আরসিবিসিকে দায়ী করবেন। যদি ফিলিফাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরসিবিসিকে সাকসেসফুলি লাইঅ্যাবল করতে পারে, তাহলে আমাদের পুরো টাকা ফেরত আসবে।
তিনি আরো বলেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি সিআইডি বিশদভাবে তদন্ত করছে। সরকারের কমিটি তদন্ত শেষ করেছে এবং রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আছে। ফরেনসিক তদন্ত করেছে ফায়ারআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের রিপোর্টও সরকারের কাছে। সরকার দেখে এটা আমাদেরকে দিবে। যদি কোনো অ্যাকশনের প্রয়োজন হয় সরকার আমাদের জানাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি বিষয়ে গভর্নর বলেন, আমাদের পুরো সিস্টেমের জন্য একটি রেমিডিডেশন প্লান নিয়েছি। যেটাতে সুইফট সিস্টেম পুরোপুরি স্টাবিলিস্ট করছি। সব টেকনোলজি নতুন করে লাগাচ্ছি। এটা হলে আমরা সিকিউরড। তিনি জানান, সুইফটের নতুন সিস্টেম আসার পরে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অডিট হবে। যারা সুইফট বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না। তারা অডিট করে বলবে ঠিক আছে। তারপর নতুন সিস্টেমে কার্যক্রম শুরু হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন