শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দুশ্চিন্তায় বিনিয়োগকারী ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আগ্রহী টেলিকম কোম্পানি

প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা মানতে চাইছেনা একাধিক টেলিকম অপারেটর। ব্যাংকগুলোকে শুধু প্রযুক্তিগত সেবা দেয়ার কথা থাকলেও একাধিক অপারেটর সরাসরি এ সেবায় আসতে চাইছে। এতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এমনকি দুটি পৃথক সেক্টর স্বার্থের দ্বন্দে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিমিষেই টাকা পাঠানোর জনপ্রিয় ডিজিটাল এই সুযোগ হুমকির মুখে পড়বে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, টেলিকম কোম্পানিগুলো সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করলে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা নিবে না। গ্রাহকরাও ভোগান্তির মুখে পড়বে। কারণ ব্যাংকিং সেবা ও সেলফোন সেবা পৃথক। মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের কোন মডেল না। ব্যাংক টাকা নিয়ে লেনদেন করে। অথচ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা সম্পর্কিত নীতিমালায় সেলফোন অপারেটরদের শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের কথা রয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ নীতিমালা পরিবর্তন করে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চাপ প্রয়োগ করছে একটি মহল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। কিছুদিন পূর্বে এ বিষয়ক গাইডলাইন পরিবর্তন করার চিন্তা করেছিলাম। নতুন গাইডলাইনও তৈরি করা হয়েছিল। এরপর আর আগায়নি।
গ্রামীণফোনের মোবিক্যাশের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে এজেন্ট নিয়োগ করে ব্যবসায় আসার কথা। একই সঙ্গে এজেন্টকে আলাদা ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনার জন্য মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখনো এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ চলছে। তাদের কি করতে হবে বলেছি। না করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে গ্রামীণফোন সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং করতে পারবেনা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই খাতে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো বলছে, দু’টি খাতের একই ব্যবসা হলে স্বার্থের দ্বন্দ দেখা দিবে। মোবাইল অপারেটরদেরকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সুযোগ দিলে নিয়ম অনুযায়ী এতোদিন ব্যবসা করে আসা ব্যাংকগুলোর এই খাতে করা বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে।
সূত্র মতে, ইতোমধ্যে গ্রামীণফোন মোবিক্যাশ নামে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বিষয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। অথচ ক্যাশ ইন বা ক্যাশ আউট করার অনুমতি নেই তাদের। বাংলালিংক ডিজিটাল মানি (ডি-মানি) নামে শিগগিরই মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। এই লেনদেনের জন্য কোনো ব্যাংকের সহায়তা নেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, প্রান্তিক জনগণের কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন হয় একই বছরের ২০ ডিসেম্বর; যা মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারী সব ব্যাংককে মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনা অমান্য করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলেও জানানো হয়। এ সংক্রান্ত নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা- এ সেবা অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে দিতে হবে। সেলফোন অপারেটররা শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সেবা দিচ্ছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করলেও এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’। বর্তমানে ১৯টি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা থাকলেও মোট লেনদেনের উল্লেখযোগ্য অংশ হয় বিকাশের মাধ্যমে। শুধুমাত্র বিকাশের গ্রাহক সংখ্যাই বর্তমানে ২ কোটি ৩০ লাখ। ৩৫ লাখের বেশি গ্রাহক প্রতিদিন লেনদেন করছেন। গত মাসেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৬১৬ কোটি লেনদেন হয়। যার ৮০ শতাংশ বিকাশের মাধ্যমে। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে বিশ্বে সর্ববৃহৎ মোবাইল ফিনেন্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে এএফআই পুরষ্কারও পেয়েছে।
মোবাইলে সঞ্চয়, দৈনন্দিন কেনা-কাটাসহ সব ধরণের কাজই সম্পন্ন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এমনকি চুরি-ছিনতাইয়ের ঝুঁকি কমাতে ক্যাশের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। ব্যাংকগুলো সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং করতে পারে না বিধায় এ কার্যক্রমের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে। নির্ধারিত কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। মে মাস শেষে ব্যাংকগুলোর মনোনীত এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৪৩২; যা আগের মাসে ছিল ৫ লাখ ৭৭ হাজার।
প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে অর্থাৎ দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সর্বত্রই টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি করেছে মোবাইল ব্যাংকিং। মূলতঃ কম সময়ে টাকা পাঠানোর সুযোগের ফলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার দ্রুত প্রসার ঘটছে। বর্তমানে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। গ্রাহকসংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ৩ কোটি। মোবাইল অপারেটররা ব্যাংকিং ব্যবসায় আসলে বর্তমানে জাতীয় সম্পদে পরিণত হওয়া মোবাইল ব্যাংকিং বিপাকে পড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ট্রান্সপারেন্ট না হলে ব্যবসা গ্রো করবে না। ২০১১ সালে চালু করা গাইডলাইন পরিবর্তনের জন্য জোড় প্রচেষ্টা বা এর পরিবর্তন এখনই ঠিক হবে না বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসিএমপিএস/পিএসডি/৫৭/ ২০১০-৪৯৫ পত্র দিয়ে গ্রামীণফোনকে মোবিক্যাশের মাধ্যমে তিন ধরনের সেবার অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো হলো- ট্রেন ও ক্রিকেট টিকিট ক্রয় এবং পরিষেবা বিল পরিশোধ। যদিও গ্রামীণফোন এই অনুমোদন নিয়ে নিজেরাই হিসাব খুলে ব্যাংকিং সেবা প্রদান শুরু করে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে মোবিক্যাশের ৩০ হাজার ৫শ’ এজেন্টকে আলাদা ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনার জন্য মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনকে নির্দেশ দিলেও তারা সে অনুযায়ী কাজ করেনি। পার হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেয়া ছয় মাস সময়। তাই এ কাজটি শেষ করার জন্য সম্প্রতি আরও তিন মাস অতিরিক্ত সময় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাও প্রায় শেষ পর্যায়ে।
গ্রামীণফোন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, মোবাইল ফিনেন্সিয়াল সার্ভিসেস লেনদেন স্বচ্ছ, স্ষ্ঠুু ও নিরাপদ রাখা ও হিসাবায়ন সহজ করার জন্য ৬ মাস সময়ের মধ্যে আপনাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিটি ব্যাংকের জন্য এজেন্টদের পৃথক পৃথক হিসাব খোলা ও পরিচালনা করতে বলা হয়েছিল। যার সময়সীমা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পুনরায় পারামর্শ দেয়া হলো। সেই সঙ্গে প্রতি মাসে এর অগ্রগতি প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে বলা হয়েছে। পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ থেকে এ চিঠিটি গ্রামীণফোনকে দেয়া হয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে সেবা দেয়ার জন্য ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে গ্রামীণফোনের চুক্তি রয়েছে। এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিতে হলে সবক’টি ব্যাংকেই এসব এজেন্টের হিসাব থাকতে হবে। এজেন্টদের মাধ্যমে সেবা দিতে গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যাংকগুলো হলো- ডাচ্-বাংলা, মার্কেন্টাইল, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ওয়ান ব্যাংক, আইএফআইসি ও ইউসিবিএল।
দ্বিতীয়বারের মত কেন গ্রামীণফোনকে চিঠি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. ইস্কান্দার মিয়া বলেন, মোবিক্যাশের এজেন্টগুলো নির্ধারিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কোন চুক্তি করে নাই। আমরা ছয় মাসের সময় দিয়েছিলাম সেটা হয় নাই। এরপর আরও তিনমাসের সময় দেয়া হয়েছে। অনেকেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়, তবে সেটা তো নিয়মের বাইরে হতে পারবে না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন