পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ : গো-খাদ্যের তীব্র সঙ্কট : ডুবে গেছে ফসলের বীজতলা
ইনকিলাব ডেস্ক : দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার উপর দিয়ে। এতে বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ভাঙনের তীব্রতা। পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বানের পানিতে ভাসছে লাখ লাখ মানুষ। বিভিন্ন স্থানে ডুবে গেছে রোপা ও আমনের বীজতলা। শত শত ঘর-বাড়ি পানির তোড়ে ভেসে যাওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত
গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ঘাঘট নদীর পানি ৬৮ সে. মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের বালাসি পয়েন্টে ৫৮ সে. মি. বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সাঘাটা-গাইবান্ধা, ফুলছড়ি সড়কের ভরতখালী ও উল্যাবাজার এলাকার ১০টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় যে কোনো সময় জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যাকবলিত জেলার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নে পানিবন্দি প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ এখন দুর্ভোগের কবলে পড়েছে। জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলায় পানিবন্দি মানুষদের জন্য ১৫৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় জেলার ৮২টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বন্যা এবং অতি বৃষ্টিতে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৭১২ হেক্টর জমির শাক-সবজি, আমন বীজতলা, রোপা আমন ও আউশ ধান তলিয়ে গেছে। এছাড়া অন্যান্য ফসলি জমি তলিয়ে গেছে ৬৬৭ হেক্টর।
নদী ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুলছড়ি উপজেলার উত্তর খাটিয়ামারী জামে মসজিদ, চন্দনস্বও জামে মসজিদ, উত্তর খাটিয়ামারী নুরানী মাদ্রাসাসহ ফজলুপুর ইউনিয়নের ৪ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
জানা গেছে, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৪৫০ মে. টন চাল ও ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের মাঝে এ পর্যন্ত ৩শ’ মে. টন চাল, নগদ ২ লাখ টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
বগুড়া অফিস জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনটে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল বুধবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৭ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আকস্মিক এই বন্যায় ভান্ডারবাড়ী ও গোসাইবাড়ী ইউনিয়নে কৃষকের শতাধিক হেক্টর জমির উঠতি আউশ ধান, পাট ও শাক-সবজি তলিয়ে গেছে। এছাড়া কয়েক হাজার বাড়ি-ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র ছুটছে। কেউবা বাঁধের উপর ছাপড়া ঘর তুলে গবাদিপশু নিয়ে বসবাস করছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সারিয়াকান্দির ১০ ইউনিয়ন ও ধুনটের ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের বৈশাখী, শহড়াবাড়ী, বানিয়াজান, শিমুলবাড়ী, কৈয়াগাড়ী, ভুতমারী, নিউ সারিয়াকান্দি, ভান্ডারবাড়ী ও রাঁধানগর গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার বাড়ি-ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত লোকজন বাঁধের উপর ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে নিজ বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলাম জানান, আকস্মিক বন্যায় ভান্ডারবাড়ী ও গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের ৩ হাজার ২৮৭ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য ২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দুই-এক দিনের মধ্যে বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করা হবে।
মানিকগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচাঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল ও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বিআইডব্লিউটি-এর আরিচা কার্যালয়ের গেজ রিডার আলমগীর হোসেন জানান, যমুনা নদীর আরিচা পয়েন্টে গত কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিক মাত্রায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বুধবার সকাল ৯ টায় ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৭১ সেন্টিমিটার পৌঁছেছে। যা বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ইসলামপুরে বানে ভাসছে লাখো মানুষ
ইসলামপুর (জামালপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বানে ভাসছে লাখো মানুষ। উপজেলার সার্বিক বন্যার পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ পাঠক আব্দুল মান্নান জানান, বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বন্যার পনি যমুনার ২০.৫৭ সেন্টিমিটার পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ২০.৫৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০৪ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে উপজেলার ৯৫টি সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি উঠায় বিদ্যালয়গুলো সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
গতকালও নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের রামভদ্রা এবং চিনাডুলি ইউনিয়নের চিনাডুলি এলাকায় বন্যায় পানির ঘূর্ণীয়মান ¯্রােতের আবর্তে রাস্তা ভেঙে শতাধিক বাড়ি-ঘর বন্যার ¯্রােতে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তবে প্রাণহানীর কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে।
যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে ইসলামপুর উপজেলার শিংভাঙ্গা সড়ক এবং ইসলামপুর গুঠাইল আমতলী ডেবরাইপ্যাচ, উলিয়া, নোয়ারপাড়া ও চিনাডুলী সড়কগুলো তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী উপজেলার পাথর্শী কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলী, নোয়ারপাড়া, ইসলামপুর সদর, ইসলামপুর পৌরসভার একাংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় প্লাবিত হয়ে প্রায় লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষ উঁচু স্থানে, বিভিন্ন স্কুলে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে বন্যা-দুর্গত এলাকায় মানুষের খাদ্য বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি গো-খাদ্যে চরম সংকট দেখা দিয়েছে। হাঁস, মুরগি বানের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা জানান, বন্যার পরিস্থিতি চরম অবনতির কারণে পল্টি খামারিরা চরম হতাশায় ভুগছে।
পদ্মার চরাঞ্চলের ৪ ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি
শিবচর উপজেলা সংবাদদাতা জানান, মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৪০ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এই উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের ৪টি ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তার উপর পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নেয়ায় চরজানাজাত ও সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
জানা যায়, গত কয়েকদিনে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার চরজানাজাত, বন্দরখোলা, কাঠালবাড়ি ও মাদবরচরের ইউনিয়নের অধিকাংশ ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পরায় মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এসকল এলাকার ফসলি মাঠ, টিউবওয়েল, স্কুলেও পানি ঢুকে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। একদিকে বন্যার পানি আরেক দিকে পদ্মার ভাঙনে আক্রান্ত হয়ে চরজানাজাতের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
পানিবন্দি সাড়ে ৫ লাখ মানুষ
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি’র আরও অবনতি ঘটেছে। টানা ১০ দিন ধরে স্থায়ী বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। প্রবল ¯্রােতের টানে ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও মূল্যবান সম্পদ। পানিবন্দি মানুষগুলো পড়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। বন্যায় পাকা ও কাচা সড়ক ডুবে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ধরলা নদীর পানি ১০৬ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৯ উপজেলার ৫৫ টি ইউনিয়নের ৭১২ গ্রাম এখন পানির নিচে। এতে পানিবন্দি হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬টি পরিবারের ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩ জন মানুষ। একই সময় নদী ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ পরিবার।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ১০, ধরলায় ৬, দুধকুমারে ১২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে।
উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউপি চেয়ারম্যান আকবর আলী জানান, কাজিরচরে তিস্তার নদীর একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার অংশ ভেঙে যাওয়ায় ৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমন ও বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নাগেশ^রীর নুন খাওয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: শাহজামাল জানান, সারিসুরি গ্রামে একটি বেড়ি বাঁধ ভেঙে সংলগ্ন ৫-৬টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, যাত্রাপুর বাজার সংলগ্ন একটি বেড়ি বাঁধ ভেঙে শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেসে গেছে। ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান এজাহার আলী জানান, ধরলা নদীর পানির প্রবল চাপে রামপ্রসাদ গ্রামে একটি রাস্তা ভেঙে ৭-৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে রোপা আমন ও বীজতলা।
সুন্দরগঞ্জে ৪২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। দু’দিনের ব্যবধানে লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় ৪২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বানভাসি মানুষজন বিভিন্ন সমস্যায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, চরাঞ্চলের ৪২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি উঠায় কর্তৃপক্ষ পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছেন। সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ১০০ মেট্রিকটন চাল ও ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ইউএনও (ভারঃ) হাবিবুল আলম জানান, নতুন করে আরও ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের ত্রাণ বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন