গৃহপালিত বিরোধী দল থাকায় বর্তমান সংসদ নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু ২৩ জুন বাজেট আলোচনায় ‘মানব পাচারকারী ও তার স্ত্রী কীভাবে সংসদ সদস্য হলেন’ জানতে চেয়ে হৈচৈ ফেলে দেন বিএনপির সরকার অনুগত এমপি হারুনুর রশীদ। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজ দুষ্কৃতকারী, মাদকপাচারকারী, অর্থআত্মসাৎকারী, মানুষের হক নষ্টকারী ও সরকারি সম্পদ আত্মসাৎকারীরা এখন সমাজে ভদ্রলোক এবং ক্ষমতায় আছেন, এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। মানবপাচারে জড়িত শীর্ষ ব্যক্তি এই সংসদের সদস্য। তার স্ত্রী কী করে সংসদ সদস্য হলেন?’
সংসদে দেয়া আলোচিত এমপি হারুনুর রশীদের বক্তব্যের কিছুটা জবাব মেলে গতকাল প্রথম আলো পত্রিকায় ‘টাকার জোরেই সস্ত্রীক সাংসদ’ শিরোনামে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
এর আগে দৈনিক ইনকিলাবসহ অন্যান্য দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ায় কুয়েতে লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল গ্রেফতারের পর টাকা দিয়ে এমপি হওয়ার নেপথ্য কাহিনী প্রকাশিত হয়। ভোটের কয়েক দিন আগে কেন্দ্র থেকে সাংগঠনিক চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহিদের পক্ষে প্রচারণায় নামার নির্দেশনা পাওয়া নিয়ে লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদন যেন ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়ার মতোই। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাপুলকে এমপির মিশনের কারণেই জাপার মহাসচিব পদে পরিবর্তন হয়। পাপুলকে এমপি করা নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বেইলি রোডের বাসায় বৈঠক হয়। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি থেকে ভোটের ৮ দিন আগে চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলামের পক্ষে কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়। এইচ টি ইমামের পক্ষে চিঠিটি পাঠান নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী সেলিম মাহমুদ। লক্ষীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর উদ্দিন চৌধুরী, যুবলীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মোহাম্মদ আলী খোকন যা বলেছেন তাতে তারা অনিচ্ছা সত্তে¡ও কেন্দ্রের নির্দেশ পালন করেছেন।
কুয়েত থেকে হঠাৎ করে এসে কাজী পাপুল কীভাবে এমপি হলেন? তাকে কারা এমপি বানালো তা ছবির মতো পরিষ্কার। হাঁড়ির একটি ভাত টিপলেই বোঝা যায় ভাত হয়েছে কিনা; তেমনি কাজী শহিদ পাপুল ও তার স্ত্রীকে সংরক্ষিত আসনের এমপি কারা বানিয়েছেন তা পরিষ্কার।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী মানবপাচারকারী পাপুলকে এমপি বানানোর রূপকার এইচ টি ইমাম। এখনো তার ভয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও কাঁপেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় প্রশাসনে তিনিই সর্বসর্বা। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার ছায়া। প্রধানমন্ত্রী তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রবীণ আমলা এইচ টি ইমামের অপছায়া যেন সর্বত্রই। যেখানে অপকর্ম, সেখানেই আসে তার নাম। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের ঘটনার পর নূর হোসেনকে সেল্টার দেয়ার অভিযোগ সে সময়ে মিডিয়াগুলোতে আসে। পাপিয়া কান্ড, ক্যাসিনো কান্ড সবকিছুতেই তার ছায়া। তিনি যেন একাই একশ’।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকার কারণে নেতাকর্মীদের ওপর প্রভাব খাটান, আবার প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি ও আমলাদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করেন। প্রশাসনের যেখানে যাবেন সেখানেই এইচ টি ইমামের নাম। বয়োবৃদ্ধ সাবেক এই আমলা যেন বর্তমান সরকারের নিয়ন্তা হয়ে গেছেন। অথচ তার কারণে প্রশাসনের অভ্যন্তরে যেমন আছে অসন্তোষ; তেমনি অনিয়ম-দুর্নীতি করে অপকর্মের হোতারা বার বার পার পেয়ে যাচ্ছেন।
করোনার প্রাদুর্ভাবে বোঝা যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যখাতের কী বেহাল চিত্র! ১৭ কোটি মানুষের দেশে কয়টা আছে আইসিইউ বেড!! প্রতিবছর বাজেটের এতো টাকা কোথায় খরচ হয়েছে? ফরিদপুর হাসপাতালের পর্দা কেনা, চট্টগ্রামে চেয়ারটেবিল কেনার মতো ঘটনায় সব টাকা খরচ হয়ে গেছে? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের কি বিচার হয়েছে? করোনার সঙ্গে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ভয় শুরু হয়ে গেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মশা মারা নিয়ে বরাদ্দ হয়, কিন্তু সে টাকা কার পকেটে যায়? এখনই বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে। প্রতি বছর অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের নামে টাকা খরচ করা হয়। তারপরও মানুষের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ে।
প্রতিবছর বাজেট ঘোষণায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। উন্নয়ন কাজে সে টাকার কতটুকু খরচ করা হয়েছে? গত ২১ জুন শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ওই সভার সভাপতির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পাড় কেটেই পুকুর খননের বিল নেয়া হয়। পুকুরের চারপাশ পরিষ্কার করেই পুকুর কাটার বিল নেয়া হয়’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের একজন এইচ টি ইমাম যেন সবকিছুর রক্ষক-ভক্ষক হয়ে গেছেন।
এতো উন্নয়নের টাকা যায় কোথায়? ব্যাংকিং সেক্টরের এই দূরবস্থা কেন? বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার শতকরা ৫০ ভাগ টাকার কি উন্নয়ন হয়? হলে সব সেক্টরে এতো বেহাল অবস্থা কেন? পিঠা ভাগের মতো প্রতিবছর উন্নয়নের টাকা ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু খরচের নামে হয় লুটপাট। বিদেশি জার্নালের গবেষণায় বলা হয়েছে ‘অল্পসময়ে সবচেয়ে ধনী হওয়ার দেশ বাংলাদেশ। ধনীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে’। এরা কারা? করোনার সময়েও কারা বিশেষ বিমান ভাড়া করে বিদেশ ঘুরতে যায়? বিদেশে টাকা পাচার, কানাডায় বেগমপল্লি, থাইল্যান্ডে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ইত্যাদি চিত্র বলে দেয় এরা কারা। অথচ বাজেটে পিঠা ভাগের মতো বরাদ্দ দেয়ার বদলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কিছু টাকা থাকলে বিপদে-আপদে মানুষ সুবিধা পেত। প্রধানমন্ত্রী ভরসাস্থল। তিনি আছেন বলেই এই করোনার মধ্যেও মানুষ খেতে পারছেন। প্রায় ৬ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে কেবল প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
দেশ এখন আমলা নির্ভর। সেই আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করেন এইচ টি ইমাম। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতের দৈনিক আল রাই, ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস পত্রিকায় প্রথম কাজী পাপুলের মানবপাচার, অর্থপাচারসহ নানা কেলেঙ্কারীর খবর প্রকাশ হয়। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই বলেন, ‘ফেইক নিউজ’। ৬ জুন পাপুল গ্রেফতারের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কুয়েত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। অথচ এখন কুয়েতের নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবুল কালাম আজাদকে পাপুল অপকান্ডে জড়িত থাকায় সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
প্রবাদে রয়েছে ‘কান টানলে মাথা আসে’। কাদের অপকর্মে সরকারকে বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় তা পরিষ্কার। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের মধ্য সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেই মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে কাজী শহিদ পাপুল এমপি মানবপাচার-অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মর্যাদা নষ্ট করেছেন। তিনি শ্রমবাজারের ওপর আঘাত হেনেছেন। দলের নিবেদিনপ্রাণ নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে এই পাপুলদের এমপি করা হচ্ছে কেন? আওয়ামী লীগের নেতারা ইতোমধ্যেই সে প্রশ্ন তুলেছেন। কুয়েতে পাপুলের বিচার হলেও সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ তাকে যারা সৃষ্টি করেছেন সেই এইচ টি ইমামরা প্রশাসনের উচ্চস্তরে বসে আছেন আরও পাপুলের জন্ম দিয়ে এমপি করবেন বলে। বঞ্চিত হবেন দলের নেতাকর্মীরা। অতএব সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন