রফিকুল ইসলাম সেলিম : নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে মুরাদপুর ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ষাট ভাগের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। জানুয়ারির শুরুতে ফ্লাইওভারটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। দ্রুত কাজ শেষ করতে রাতদিন শ্রমিকেরা কাজ করে যাচ্ছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, ফ্লাইওভারে ইংরেজি ‘ওয়াই’ আকৃতির মোট ৯৩টি পিয়ারের মধ্যে ওয়াসা মোড় এলাকায় চারটি বাকি আছে। বাকি সব পিয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৭৫২টি গার্ডারের মধ্যে তৈরি হয়েছে অর্ধেকের মতো। এর মধ্যে ২৬০টি গার্ডার ওয়াই আকৃতির পিয়ারের ওপর সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান গতকাল (শুক্রবার) ইনকিলাবকে জানান, আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পে কাজ শেষ করার জন্যে সময় নির্ধারিত থাকলেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে অনেক আগেই কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশা করি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর সবচেয়ে বড় এই ফ্লাইওভারটি চালু হলে দেশের বাণিজিক রাজধানী চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে, অকেনটাই যানজটমুক্ত হবে বন্দরনগরী, এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। নির্মাণ কাজের জন্য প্রধান সড়কের প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকার বিশাল অংশ দখল নেওয়ায় ওই এলাকায় তীব্র যানজট হচ্ছে। এতে নগরবাসীর পাশপাশি ওই এলাকায় বসবসকারীদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগে নির্মাণ কাজ শেষ হলে জনদুর্ভোগের দ্রুত অবসান হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম জানান, আগামী জানুয়ারিতেই মুরাদপুর-ওয়াসা পর্যন্ত আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। মূলকাজ শেষ করেই র্যাম্প ও লুপ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। তিনি জানান, দুই নং গেট মোড় থেকে অক্সিজেনমুখী গাড়ি ওঠানামার জন্যে দুটি লুপ নির্মাণের বিষয় মূল ডিপিপিতে ছিল। সেখানে একটু পরিবর্তন এসেছে। আগে ছিল আরসিসি, এখন ব্যয়বহুল ও সর্বাধুনিক স্টিল ফ্রেম দেওয়া হচ্ছে।
জিইসি মোড়ের জাকির হোসেন সড়কের গাড়ি ওঠানামার সুবিধার্থে যে র্যাম্প তারও স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। আরেকটি বড় পরিবর্তন এসেছে গার্ডারগুলোর সংযোগ স্থলে আমরা ফিঙ্গার টাইপ জয়েন্ট দিচ্ছি, যাতে ফ্লাইওভার দিয়ে পিয়ারগুলো গাড়ি চালিয়ে অতিক্রমের সময় ঝাঁকি খেতে না হয়। এটি না করলে ৯৩ বার ঝাঁকি খেতে হতো।
তিনি বলেন, যেহেতু কাজের গুণগতমান ও পরিমাণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, দৈর্ঘ্য বেড়েছে, নির্মাণকাজ চলাকালীন দু’পাশে সড়ক দেবে যাওয়া বন্ধে শিট পাইলিং করা হয়েছে এবং দুই বছরের বেশি সময় দু’পাশের সড়ক নিয়মিত মেরামত করে স্বাভাবিক রাখতে হয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। আমরা টেকসই কাজের জন্যে যা যা করার দরকার সবই করছি। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে নিখুঁত কাজের ক্ষেত্রে মুরাদপুর ফ্লাইওভার একটি দৃষ্টান্ত হবে। অতীতে সব ফ্লাইওভারে ক্রেনের সাহায্যে গার্ডারগুলো তোলা হতো। সে জায়গায় আমরা ব্যবহার করছি লাঞ্চার।
তিনি জানান, লুপের জন্যে যে স্টিলের কার্ভ ব্যান আনা হবে তা আসবে চীন থেকে। প্রায় ৭০ ফুট উপরে দুই নং গেট এলাকায় ওই লুপ হবে। যা আরসিসি দিয়ে করলে কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যেত। এক্ষেত্রে আমদানি করা ও ফিটিংসে সময় লাগবে। তাই লুপ-র্যাম্প ছাড়াই মুরাদপুর থেকে ওয়াসা পর্যন্ত ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে চায় কর্তৃপক্ষ। তিনি জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ চলছে। যেসব গার্ডার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সেখানে ক্রসগার্ডার (দুই গার্ডারের মধ্যে সংযোগ), স্ল্যাব তৈরির কাজ চলছে।
বিগত ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ৫.২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ফ্লাইভার। এই ফ্লাইওভারের দরপত্র খোলা হয় গত ১৫ মে। পরে পাঁচ দশমিক দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি নির্মাণে গত ২৮ অক্টোবর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিনের (জেভি) সঙ্গে সিডিএর চুক্তি হয়।
দুই বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। মুরাদপুর থেকে ওয়াসা জংশন পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার ফ্লাইওভারে চারটি লেইন থাকছে। এছাড়া দুই নং গেইট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত দুই লেনের দশমিক শূন্য সাত কিলোমিটার (নিম্নমুখী) র্যাম্প ও অক্সিজেন থেকে জিইসিমুখী দুই লেইনের এক কিলোমিটার (ঊর্ধ্বমুখী) র্যাম্প থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ২০১০ সালের ২ জানুয়ারী নগরীর বহদ্দাহাট জংশনে একই সাথে ৫টি ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। পরে পাঁচটি ফ্লাইওভারের বদলে বহদ্দারহাটে একটি এবং মুরাদপুর থেকে ওয়াসা হয়ে ইস্পাহানি মোড় পর্যন্ত একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, মুরাদপুর ফ্লাইওভারটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে নগরীর ওই প্রধান সড়ককে ঘিরে যানজট একেবারেই কমে যাবে।
এর প্রভাবে নগরীর সিইজি মোড় হয়ে জাকির হোসেন রোড, ষোলশহর থেকে বায়েজিদ বোস্তামি সড়ক হয়ে অক্সিজেন পর্যন্ত এলাকায় যানজট থাকবে না। একই ভাবে নগরীর ও আর নিজাম রোডসহ আরও কয়েকটি সড়কে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। মুরাদপুর ফ্লাইওভারকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নগরীর সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন