বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অতীতকে স্মরণে রেখেই তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
একাত্তরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে তৎকালীন পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি স্বাধীনতার পূর্বের বাঙালিদের অবস্থান তুলে ধরতে চাই। আমি এটা বারবারই প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, তার কারণ এই বৈষম্যের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
তিনি বলেন, আমাদের অতীতকে স্মরণ রাখতে হবে, এটাই আমাদের ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি জোগাবে।
শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার রাতে শেরেবাংলা নগরে পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন ২০১৬-তে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা এনে দেন। এটা কিন্তু এক দিনে আসেনি। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনের মাধ্যমেই এই স্বাধীনতা আসে।
তিনি বলেন, কিন্তু আজ অনেকেই ভুলে যান তখন (স্বাধীনতার পূর্বে) বাঙালিদের কী অবস্থা ছিল, বাঙালিরা কোন অবস্থানে ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময়ে বাঙালিরা চরম শোষিত, নিগৃহীত এবং বঞ্চিত ছিল। খাদ্য, পরনের কাপড়, চিকিৎসা, শিক্ষাÑসবকিছুর অভাব ছিল।
তিনি বলেন, মায়ের কোলে অভুক্ত শিশুর মৃত্যু, দিনের পর দিন না খেতে পারা অভুক্ত মানুষ, কোন আশ্রয় নেই, ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, এই অভুক্ত, নিরন্ন মানুষগুলোর অধিকারের কথা বলাতেই বঙ্গবন্ধুকে সে সময় বারংবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জাতির পিতা ভাষণ দিলেই মামলা, জেল, জুলুম-নির্যাতন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু তার অবস্থান থেকে এতটুকু টলেননি। বরং তিনি তার নীতির প্রতি অবিচল থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন ১২শ’ মাইলের দূরত্বে পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের একটি ছিল পূর্ববাংলা এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান।
আমরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে যেমন বেশি ছিলাম, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, যখন আমরা বাঙালিদের আজকের অবস্থান দেখি, দেখি তারা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানিরা একটু খর্বকায় এবং হালকা-পাতলা বলে বাঙালিদের পাত্তাই দিত না, বাঙালিরা দেশ চালিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে, এটা তারা মানতেই চাইত না।
তিনি বলেন, যে পাকিস্তানিরা আমাদের অবহেলা করত তাদের কাছেই পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। বাঙালি দেখিয়ে দেয় যে, আমরাও পারি। জাতির জনক যে বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না, তারা পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ শতাংশ পূর্ববাংলার হলেও এবং বাঙালিরা অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও পাকিস্তানিরা সে সময় সেই টাকাতেই করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদে তিন তিনবার রাজধানী স্থানান্তর করে।
শেখ হাসিনা বলেন, পূর্ববাংলার মানুষের উন্নয়নে পাকিস্তানিরা একটি কদমও আগে বাড়ায়নি। সে সময় পূর্ব বাংলায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা হলেও শুধু জায়গা চিহ্নিত করা ব্যতীত আর কাজ এগোয়নি। উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে পরে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। যাই হোক, আল্লাহর রহমতে আমরা এতদিনে ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।
১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় কর্মক্ষেত্রে পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত বৈষম্যের যে চিত্র উপস্থাপিত হয় তা প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে আনেন। পাকিস্তান সরকারে সচিবদের পদ ছিল ২২টি। যার সবক’টির পদাধিকারী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
যুগ্ম-সচিব পদে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৪২ জন এবং বাঙালিদের ৮ জন। উপ-সচিব ৬৯টি পদে আসীন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা, অন্যদিকে ২৩ জন ছিল বাঙালি। সেকশন অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল ৩২৫ জন আর বাঙালিরা ৫০ জন। প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩ হাজার ৭৬৯ জন এবং বাঙালি ৮১১ জন। সিনিয়র গেজেটেড অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি ৬৯২ জন আর বাঙালি ৪২ জন।
ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে পশ্চিম পাকিস্তানি ১৬২ জন আর বাঙালি ৩ জন। রেডিওতে পশ্চিম পাকিস্তানি ৯৮ জন আর বাঙালি ১৪ জন। সাপ্লাই অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনে পশ্চিম পাকিস্তানি ১৬৪ জন আর বাঙালি ১৫ জন। রেলওয়েতে পশ্চিম পাকিস্তানি ১৫৮ জন আর বাঙালি কর্মকর্তা ৫০ জন। ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগে পশ্চিম পাকিস্তানি ২৭১ জন আর বাঙালি ৫০ জন। এগ্রিকালচার ইকোনমি কর্পোরেশনে পশ্চিম পাকিস্তানি ৩৮ জন আর বাঙালি ১০ জন। বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানি ১ হাজার ৭৫ জন আর বাঙালি ৭৫ জন। সার্ভে অফিসার পদে পশ্চিম পাকিস্তানি ৬৪ জন আর বাঙালি মাত্র ২ জন কর্মরত ছিলেন।
সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও ভয়াবহ ছিল বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানিদের চোখে বাঙালিরা ছিল খর্বকায়, হালকা-পাতলা-রুগ্ন এবং সাহসী নয়।
শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩টি জেনারেল পদ, ২০টি মেজর জেনারেলের পদ এবং ৩৪টি ব্রিগেডিয়ারের পদের সবক’টিতেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা আসীন ছিল। কর্নেল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল ৪৯ জন এবং বাঙালি মাত্র একজন। লে. কর্নেল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি ১৯৮ জন আর বাঙালি ২ জন। মেজর পদে পশ্চিম পাকিস্তানি ৫৯০ জন আর বাঙালি ছিল ১০ জন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌবাহিনীর ৬শ’ পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি ৫৯৩ জন এবং বাঙালি ছিল ৭ জন। অন্যদিকে বিমান বাহিনীর ৬৪০টি পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি ৬শ’ পদে আর বাঙালিরা ৪০টি পদে আসীন ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভয়াবহ বৈষম্য ছিল।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ৬টি আর পূর্ববাংলায় একটি। প্রকৌশল কলেজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৩টি আর পূর্ব বাংলায় একটি। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি আর পূর্ববাংলায় ২টি। কলেজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৬টি আর পূর্ববাংলায় ৫৬টি। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাইমারি স্কুল ছিল ৬ হাজার ২৪৬টি আর পূর্ববাংলায় ২ হাজার ২১৭টি। হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ১৭ হাজার ৬১৪টি আর পূর্ব বাংলায় ৫ হাজার ৫১৫টি। চিকিৎসক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৫ হাজার ৫শ’ আর পূর্ববাংলায় ৩ হাজার ৩৯৩ জন। পশ্চিম পাকিস্তানে মাতৃসদন ছিল ১১৮টি আর পূর্ব বাংলায় ২২টি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের সর্বক্ষেত্রে যে এই বৈষম্য তার কিছুটা লাঘব হয়, পাকিস্তানিদের কিছুটা টনক নড়ে ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষণার পর। তবে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ‘মার্শাল ল’ জারি করলে অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন