মোবায়েদুর রহমান : বেগম জিয়ার জাতীয় ঐক্য প্রস্তাব শুরুতেই প্রচন্ড হোঁচট খেয়েছে। অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন এবং গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), কৃষক শ্রমিক জনতা দলের কাদের সিদ্দিকি, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের কাছে ছোটাছুটি করছেন।
ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং তার পুত্র মাহি চৌধুরী আমেরিকায় থাকায় তাদের সাথে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেখা হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে টেলিফোনে কথা হয়েছে। এমাজউদ্দিন এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তার সারমর্ম হলো, ২০ দলীয় জোটকে আপাতত সাইড লাইনে রেখে ওপরে উল্লিখিত ৬টি দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তৎপর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যদিও তিনি বিএনপির কেউ নন। ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে যাদের কাছে অনানুষ্ঠানিকভাবে তিনি কথা বলেছেন তাদের প্রত্যেকে নাকি শর্ত দিয়েছেন যে, এই ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিলেই যে অন্য ৬টি দল শর্তহীনভাবে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গড়বে এমন কোনো কথা তারা দেয়নি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। বরং তাদের অনেকেই বলেছেন যে, জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেয়ার পর এই ৬টি দল এবং বিএনপিকে একটি নি¤œতম কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। ঐ কর্মসূচিতে ঐক্যমত হলে তবেই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
সিপিবির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া
ইতোমধ্যেই একশ্রেণীর সংবাদপত্রে খবর ছড়িয়েছে যে, আগামী রবিবার বেগম জিয়া এই ৬ দলের নেতৃবৃন্দকে একটি চা-চক্রে দাওয়াত করবেন। সেখানে ঐক্যের প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা হবে। অতঃপর বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা এবং ন্যূনতম কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য কমিটি বা সাব কমিটি গঠনের প্রশ্ন আসবে। কিন্তু গত মঙ্গলবার যমুনা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক টেলিভিশন টকশোতে সিপিবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন যে, জাতীয় ঐক্য নিয়ে বিএনপির তরফ থেকে কেউ তার কাছে বা তার দলের অন্য কারো কাছে এ্যাপ্রোচ করেনি। চা-চক্রের কথাও তিনি এখন পর্যন্ত শোনেননি। যমুনা টিভির টকশোতে এসে প্রথম তিনি উপস্থাপিকার নিকট থেকে চা-চক্রের কথা শুনলেন। ওই টকশোতে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান।
এই পর্যায়ে উপস্থাপিকা সিপিবির নেতা প্রিন্সকে জিজ্ঞেস করেন যে, যদি চা-চক্রের দাওয়াত আসে তখন আপনারা কি করবেন? উত্তরে প্রিন্স বলেন, সেটা তো পরের কথা। তার আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, গত বছরে বিএনপির জঙ্গিবাদী ভূমিকার কথা। আওয়ামী লীগ যে ভাষায় এবং যে বিষয়ে কথা বলে সে ভাষা এবং সুরের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি বলেন, গত বছর হরতাল ও অবরোধের নামে বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপির ককটেল ও পেট্রোল বোমা হামলায় অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। অনেক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে অকর্মণ্য হয়ে গেছেন। বিএনপির এসব কাজে সহায়তা করেছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐক্যের আগে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। বিএনপির রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ ঢুকে পড়েছে। এসব তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। শুধুমাত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ নয়, তার রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিএনপির ভূমিকাকে স্পষ্ট করতে হবে। এসব করলেই তখন ঐক্যের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। সিপিবির এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা বিএনপির কাছে যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন সেগুলো মানতে হলে বিএনপির আদর্শ এবং মেনিফেস্টো পরিবর্তন করতে হবে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই
রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রস্তাবিত জাতীয় ঐক্য সম্পর্কে যেসব শর্তের কথা বলেছেন সেগুলো তার ব্যক্তিগত কথা নয়। সেগুলো তার প্রেসিডেন্ট মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তথা সমগ্র দলের কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাবে বাসদও নাকি সিপিবির মতোই অবস্থান গ্রহণ করেছে। পর্যবেক্ষক মহলের কাছে সিপিবি এবং বাসদের এই ভূমিকায় জাতীয় ঐক্যের এমাজউদ্দিন এবং জাফরুল্লাহর মডেল শুরুতেই প্রচ- হোঁচট খেয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। কারণ সিপিবি কমিউনিজমে এবং বাসদ সমাজতন্ত্রে আজও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। তারা আওয়ামী লীগের মতোই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তাদের ভাষায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে। তারা মৌলবাদের বিরোধী। রাজনৈতিকভাবে তাদের লিংক রয়েছে ভারতের পরলোকগত কমিউনিস্ট নেতা ই এস এম নাম্বুদিরিপাদ এবং হরকিষণ সিং সুরজিতের সিপিআই-এর রাজনীতির সাথে। ৬০-এর দশকে সিপিআই বিভক্ত হয়ে গেলে নাম্বুদিরিপাদ ও হরকিষণ সিং সুরজিত সোভিয়েত লাইন অনুসরণ করেন। পক্ষান্তরে সিপিআই-এর অপরাংশ সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাত এবং জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সিপিআই (এম) নাম ধারণ করে শুরুর দিকে চীনা লাইন অনুসরণ করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি মনি সিং-এর নেতৃত্বে সোভিয়েট লাইন অনুসরণ করে। রুশ ভারত অক্ষশক্তির অনুসারী হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের আদর্শিক মৈত্রী স্থাপিত হয়। মস্কোপন্থী মোজাফ্ফর ন্যাপও ঐ আদর্শিক মৈত্রীতে শামিল হয়ে তিনদল মিলে (আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও মোজাফ্ফর ন্যাপ) গণঐক্যজোট গঠন করে। সিপিবি এবং বাসদের সাথে তাই একশত ভাগ না হলেও বিপুল অংশে আদর্শিক মিল রয়েছে আওয়ামী লীগের। সেই সিপিবি এবং বাসদ বিএনপির সাথে যায় কীভাবে সেটি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বোধগম্য হয় না।
জাতীয় ঐক্য ও ২০ দল
প্রস্তাবিত জাতীয় ঐক্যে ২০ দলের অবস্থান কি হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মৃত্যুর পর মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্য জোটের বৃহত্তর অংশ ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। এখন জামায়াতে ইসলামীকে বের করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন যদি জামায়াতকেও বেরিয়ে যেতে হয় তাহলে এই জোট ইসলামী দলশূন্য হয়ে পড়ে। ইসলামিক পার্টি নামে যে দলটি ২০ দলে রয়েছে সেটি একটি লেটার হেডসর্বস্ব দল। জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোট বেরিয়ে যাওয়ার পর আর যারা রয়েছে তাদের অবস্থা সোহরাওয়ার্দীর ০+০+০+০+০= ০ তত্ত্বের মতো। এখন এসব শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য যদি বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জেএসডি ইন করে তাহলে আওয়ামী লীগকে রাজপথে মোকাবেলা করার জন্য বিন্দুমাত্র শক্তি বৃদ্ধি হবে না। তবে এই চারদলে রয়েছে চারটি বিগ নেম। এদেরকে আগামী নির্বাচনে নমিনেশন দিতে হবে।
কিন্তু বিএনপির দলীয় কোনো ইস্যুতে এরা সমর্থন দেবেন না। মানি লন্ডারিং কেসে তারেক রহমানকে যে দ- দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে এসব সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক দল একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এরা আসার পর বর্তমানে ২০ দলে অন্তর্ভুক্ত আন্দালিব রহমান পার্থর জাতীয় পার্টি, কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামিক পার্টি, জাগপা, জামায়াত, বিএনপি, এনপিপি (নিলু) (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি), খেলাফত মজলিশ, ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক পার্টি (এনডিপি) (আলমগীর মজুমদার), লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ, ডেমোক্র্যাটিক লীগ, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি দলকে প্রস্তাবিত জাতীয় ঐক্যে রাখা হবে কিনা সেটি স্পষ্ট নয়।
নির্বাচনের প্রস্তুতি
গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তার দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং ২০১৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি করবে সে সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া গেছে। কিন্তু বিএনপি কি করবে সেটি জনগণের কাছে অস্পষ্ট। আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো ২০১৯ সালেও বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার জন্য বদ্ধপরিকর। কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকি আর আ স ম আবদুর রবদেরকে নিয়ে বিএনপিও কি এই সরকারের অধীনেই ২০১৯ সালের নির্বাচন করবে? যদি তা না করতে চায় তাহলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করতে হবে। এসব নেতা এবং তাদের দলকে নিয়ে কি রাজপথের দাবি আদায় করা সম্ভব?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন