বিশেষ সংবাদদাতা : বিআরটিএ’র হাজার কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব আদায় করছে বেসরকারি কোম্পানী সিএনএস লিমিটেড। একটি বেসরকারি কোম্পানীকে কিভাবে এতো বড় অংকের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ বিআরটিএ-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যেখানে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে সেখানে সিএনএস-এর মতো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি টাকা নিরাপদে থাকবে তার গ্যারান্টি কোথায়? একই কোম্পানীকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা-গোমতি সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে করে ৫ বছরে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে ৩শ’ কোটি টাকারও বেশি। অবাক করার বিষয় হলো, চুক্তি সম্পাদনের ৫ মাস আগে থেকেই মেঘনা ও গোমতি সেতুর টোল আদায় করছে সিএনএস।
সড়ক ও জনপদ সূত্র জানায়, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জোরে সরকারের টোল নীতিমালা ২০১৪ লঙ্ঘন করে সিএনএসকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। নীতিমালা অনুযায়ী সার্ভিস প্রোভাইডার নিয়োগের কোন সুযোগ নেই। বিআরটিএ’র হিসাব মতে, সারাদেশে রেজিস্ট্রার্ড যানবাহনের সংখ্যা ২৬ লাখ ৪০ হাজার ৩শ’ ৪৯টি। এর মধ্যে ভারি ও হালকা জীপ আছে ৪৫ হাজার, মাইক্রোবাস আছে ৮৮ হাজার, প্রাইভেট কার আছে প্রায় ৩ লাখ। এসব গাড়ি থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। একটি চুক্তির মাধ্যমে সেই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেসরকারি কোম্পানী সিএনএসকে। তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো টাকা আদায় করে চলেছে। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা আদায় করার জন্য সিএনএস ব্যাংকের সাথে পৃথক চুক্তি করে নিয়েছে। এ কারণেই টাকার হিসাব-নিকাশ নিয়ে বিআরটিএ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। কোন খাতে কতো টাকা আদায় করা হচ্ছে তার হিসাব বিআরটিএ’র কাছে নেই। কারণ সিএনএস-এর সার্ভারের সাথে বিআরটিএ-এর কোনো যোগাযোগ নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের রাষ্ট্রীয়সহ বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে একটি বেসরকারি কোম্পানীকে সরকারের হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। অভিযোগ রয়েছে, সিএনএস তাদের নিজের খেয়াল খুশি মতো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে গ্রাহকদের কাছে থেকে টাকা আদায় করছে। যাতে করে গ্রাহকরা সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছে। গ্রাহকদের কারণে বিআরটিএ-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আছেন অস্বস্তিতে। তারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না এই যা। সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি কোম্পানীকে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব তোলার দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি গাড়িসহ মালিকদের তথ্য-ভা-ারের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। সরকারি তথ্যসহ গাড়িসহ মালিকদের তথ্য পাচারের আশংকা রয়েছে।
অপরদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা ও গোমতি সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সিএনএসকে। টোল নীতিমালা অনুযায়ী ও এন্ড এম পদ্ধতিতে পরিচালিত টোল প্লাজা পরিচালনায় উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করতে হয় ৩ বছরের জন্য। এর অধিক সময়ের জন্য চুক্তি করার কোন বিধান নীতিমালায় নেই। অথচ সিএনএসকে নিয়োগ করা হয়েছে ৫ বছরের জন্য। সড়ক ও জনপথ সূত্র জানায়, কোন অপারেটরের সাথে নেগোসিয়েটেডের কোন বিধান টোল নীতিমালায় নেই। অথচ সিএনএস-এর ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে। আবার চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের পূর্ব থেকে কোন প্রতিষ্ঠানকে টোল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার বিধানও টোল নীতিমালায় নেই। অথচ সিএনএস লিমিটেডকে চুক্তির ৫ মাস আগে থেকে টোল আদায়ে নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়া ও এন্ড এম (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) পদ্ধতিতে টোল আদায়ে কোন কারণে অপারেটর নিয়োগ সম্ভব না হলে বিভাগীয় পদ্ধতিতে টোল আদায় করতে হয়। এই পদ্ধতিতে বিভাগীয় জনবল দিয়ে টোল পরিচালনা করার বিধান রয়েছে। এতে টোল পরিচালনায় জনবল খাতে সরকারের কোন খরচ নেই। ও এন্ড এম পদ্ধতিতে পরিচালিত টোল প্লাজায় অপারেটর নিয়োগ অথবা বিভাগীয়ভাবে টোল আদায় করা ছাড়া টোল নীতিমালায় আর কোন বিকল্প বিধানও রাখা হয়নি।
সূত্র জানায়, সিএনএসকে নিয়োগ দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি অতি গোপনে সম্পন্ন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে সিএনএস লিমিটেডকে আউট সোর্সিংয়ে একক উৎস হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য সড়ক ও জনপথ ঢাকা জোনের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আফতাব হোসেন খান ওই প্রতিষ্ঠানের বরাবরে গত বছরের ২৬ নভেম্বর লেটার অব ইনভাইটেশন (আরএফপি ) ইস্যু করেন। এর প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি ৫ বছরের জন্য পরিচালনার একটি প্রস্তাব দাখিল করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএনএস লিমিটেডকে আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগ দিতে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সড়ক ও জনপথের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিস্তারিত পরামর্শ করেন। ঢাকা জোনের ২৯ সেপ্টেম্বর-২০১৫, ডিজেড-৩৯৬০ স্মারকে সিএনএসকে পাঠানো এক চিঠিতে ওই আলোচনার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর সেই ক্ষেত্রটি তৈরি করা হয় গত বছরের ১৪ সেপ্টম্বর নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ২৭২৬ নং স্মারকে পাঠানো এক প্রকল্প প্রস্তাব থেকে। সেখানে ‘টোল পরিচালনায় দক্ষ জনবল নেই’- উল্লেখ করে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রস্তাবনা দাখিল করেন নির্বাহী প্রকৌশলী এ, কে শামছউদ্দিন আহাম্মদ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে সেতু দুটি থেকে টোল আদায় হয়েছে ৭৭ লাখ ৩ হাজার ৬৭ টাকা। এই হিসেবে ৫ বছরে টোল আদায় হবে ১৪০৫ কোটি ৮০ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৫ টাকা। আদায়কৃত ওই টাকার ২২ দশমিক ১৮ ভাগ হিসেবে সিএনএস লিমিটেড পাবে ৩১১ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ৩২২ টাকা। সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৫ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর এর আগের ৫ বছর টোল আদায়ে খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ টাকা। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে নিয়োগ করা অপারেটরকে সে অর্থ দেয়া হয়েছে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ। যা সিএনএস-এর সাথে করা চুক্তির টাকার চেয়ে ২৯৬ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৪১০ টাকা কম ছিল। অর্থাৎ নিয়ম না মেনে সিএনএসকে নিয়োগ দেয়ায় সরকারে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২৯৬ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৪১০ টাকা। এছাড়া বিআরটিএ-এর হিসেবে বছরে দেড় লাখ এর বেশি যানবাহন বাড়ে। এতে টোলের আয়ও বাড়বে। এতে সিএনএস-এর সাথে চুক্তির মেয়াদে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হবে সরকারের। সিএনএসকে বিধি লঙ্ঘন করে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন, এমন চুক্তি হতে পারে কখনও ভাবিনি। তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, রাষ্ট্রের ক্ষতি করে কার স্বার্থে এমন চুক্তি?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন