রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মাওলানা নূরুন্নবী রহ.

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আধ্যাত্মিক জগতের এক নীরব সাধক
মিসবাহুর রহমান মারুফ

সময়ের দাবিতে মহান আল্লাহতায়ালা তৈরি করেন এমন কিছু কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব যাদের সংস্পর্শে জেগে উঠে ঘুমন্ত মানবতা। দিশেহারা পথিক খুঁজে পায় সঠিক পথের সন্ধান। যারা নিজেকে বিলীন করে উম্মতের জন্য রেখে যান আগামীর পাথেয়। চেষ্টা, শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে উম্মতকে দিয়ে যান পথ চলার হিম্মত। তাই তো তারা মরেও হয়ে থাকেন অমর। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে। এমনই এক মনীষী হলেন মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.)। যার জীবনটাই ছিল সুন্নতে ভরা। তিনি ছিলেন তাকওয়া ও খোদাভীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত। সহনশীলতা ও দুনিয়াবিমুখতা ছিল তার মহৎ গুণ। তার চেহারা দেখলে সত্যিই আল্লাহকে স্মরণ হতো। মদিনার মসজিদে নববীতে তাকে দেখে এক বর্ষীয়ান আরব মন্তব্য করেন, ইনি তো মানুষ নয় ফেরেশতা!
তাকওয়া ও পরহেজগারির ওপরই তিনি নিজের জীবন ধারণ করেছেন। একজন সফল মুমিনের সব বৈশিষ্ট্যই তার মাঝে ছিল। তিনি অযথা সময় নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। দিনের বেশি সময় কাটাতেন কোরআন তেলাওয়াত ও তাসবিহ-তাহলিলের মধ্য দিয়ে। তাহাজ্জুদ, আওওয়াবীন, ইশরাক, চাশত ও সালাতুত তাসবিহ ছিল তার নিয়মিত আমল। উচ্চাভিলাষী জীবন থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছেন। বিনয় ও নম্রতা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অহংকার তার মাঝে ছিল না। মর্যাদাশীলদের মর্যাদা দিতেন। ছোটদের ¯েœহ করতেন। দানশীলতা ও মেহমানদারির ক্ষেত্রে তার উদারতা ও প্রশস্ত হৃদয় সর্বজন স্বীকৃত। জীবনের বেশি সময় তিনি পবিত্র কোরআনের খেদমত করেছেন। অনেক বেনামাজি তার হাত ধরে মসজিদমুখী হয়েছে। দাড়ি, টুপি ও ইসলামী আখলাক ধারণ করে পাক্কা দীনদার হয়েছে। তার প্রতিটি আমলই ছিল ইখলাস ও একনিষ্ঠতাপূর্ণ। তিনি তাওববা-ইস্তিগফারে মগ্ন থাকতেন সবসময়।
এক বছর আগে মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.) পরাপারে পাড়ি জমান। গত ২৩ এপ্রিল ২০১৫ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। মাওলনা নূরুন্নবী (রহ.)-এর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার আমানতপুরে। ১৯৪৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলবী সাঈদুল হক ইবনে মুনিরুদ্দীন (রহ.) খুবই দীনদার ছিলেন। মাতা মেহরুন্নেছা ছিলেন একজন মহীয়ষী নারী।
শিক্ষা জীবন
মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.) প্রাথমিক লেখাপড়া গ্রামেই করেন। মক্তবের হুজুর মাওলানা তরিকুল্লাহর কাছে কোরআন শরিফ শিক্ষা করেন। এরপর নোয়াখালীর প্রাচীনতম বিদ্যাপিঠ কালিকাপুর ইমদাদুল উলূম কওমি মাদরাসায় উর্দু জামাত থেকে নাহবেমির জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে ভর্তি হন লক্ষ্মীপুর বটতলীতে হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ রহ. (জনাব ওয়ালা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল মাদারেসে। সেখান থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে চলে যান বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। সেখানে হেদায়া থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি দাওরায়ে হাদিস শেষ করে ছাত্রজীবনের ইতি টানেন।
কর্মজীবন
মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.)-এর কর্মজীবন শুরু হয় তারই প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কালিকাপুর ইমদাদুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। সেখানে দুই বছরের অধিক সময় খেদমত করেন। এই মাদরাসায় থাকাকালীন তিনি বিয়ে করেন। ১৯৭৪ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার মহেশপুর গ্রামের মাওলানা দলীলুর রহমান কাসেমী (রহ.)-এর মেজকন্যা তাজকেরা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। মাওলানা দলীলুর রহমান (রহ.) ছিলেন সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর একান্ত ছাত্র ও খলিফা। পরবর্তীতে মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.) মহেশপুরেই স্থায়ী বসত গড়েন।
১৯৭৫ সালে তিনি পঞ্চগড় জেলার প্রাচীনতম প্রসিদ্ধ দীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মদিনাতুল ইসলাম মাদরাসায় খেদমতে নিয়োজিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি মদিনাতুল মুনাওওয়ারা যান। সেখানে মসজিদে নববীর খাদেম হয়ে খেদমত করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। রওযায়ে আতহার পরিষ্কার করার দায়িত্ব পেয়ে তিনি ধন্য হন। এই পবিত্র ভূমিতে তিনি প্রায় তিন বছর ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ছুটিতে দেশে আসেন। দেশে আসার সংবাদ শুনে পঞ্চগড়বাসী তাকে পুনরায় পঞ্চগড় যাওয়ার অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে আবারও তিনি পঞ্চগড় দারুল উলূম মাদ্রাসায় খেদমতে যোগদান করেন। এরপর পঞ্চগড় বাজার জামে মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগ হন। প্রায় দুই বছর দারুল উলূম মাদরাসায় খেদমত করে পরবর্তীতে শুধু মসজিদে ইমাম-খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মসজিদ সংলগ্ন রাত্রিকালীন বয়স্ক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে বয়োবৃদ্ধদের কোরআনের তালিম দিতে থাকেন। বাকি জীবন তিনি এই মসজিদ ও মাদরাসায় একনিষ্ঠভাবে খেদমত করে কাটিয়ে দেন।
জীবনের শেষ দিকে মাওলানা নূরুন্নবী (রহ.) অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। ফলে তাকে পঞ্চগড় ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। বিদায় বেলায় পঞ্চগড়বাসীর চিৎকার করে কান্না এবং চোখের অশ্রু দেখেই অনুমান করা গেছে, এই মানুষটি তাদের হৃদয়ের গহিনে কতটুকু শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসার আসনে জায়গা করে নিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল ২০১৫ রোজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিয়েট হাসপাতালে ১.৩৮ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। জীবন সংগ্রামের এই আধ্যাত্মিক সাধককে লক্ষ্মীপুরে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম নসিব করুন, আমিন।
তিনি স্ত্রী, ৬ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান। এটাও তার বড় একটি কৃতিত্ব যে, তিনি একটি আদর্শ পরিবার গঠন করে গেছেন। তিনি নিজেও একজন আদর্শ পিতা ছিলেন। তার পরিবারে শতভাগ শরঈ পর্দা মেনে চলা হয়। তার ছেলেদের মধ্যে মাওলানা মিজানুর রহমান, মাওলানা রেজাউর রহমান হাসান ও মাওলানা আতাউর রহমান বিভিন্ন মাদরাসা ও মসজিদে খেদমতে নিয়োজিত আছেন। চতুর্থ ছেলে মিসবাহুর রহমান হেফজ ও দাওরা শেষ করে ফতোয়া বিভাগে পড়ছেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ছেলে যথাক্রমে ইমদাদুর রহমান ও সালমান মাত্র হিফজ শেষ করেছে। তার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ে মাহবুবা রহমানের স্বামী মাওলানা হিফজুর রহমান একজন বিজ্ঞ আলেমে দীন, খতিব ও ব্যবসায়ী। ছোট মেয়ে খাদিজা আক্তার মাশুকার স্বামী মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান একটি মাদরাসায় মুফতি ও মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন