বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের সংঘাত সহিংসতায় অশান্ত শিক্ষাঙ্গন

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ অশান্ত। প্রায় প্রতিদিনই কলেজ দুটিতে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ। তাদের কলহ-বিবাদ আর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। উদ্বিগ্ন তাদের অভিভাবকেরা। কলেজ দুটির আশপাশের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। কখন কি ঘটে-এমন শঙ্কা ভর করছে সবার মাঝে।
এই দুটি কলেজের মতো আধিপত্য বিস্তারের জেরে ছাত্রলীগের সংঘাত-সংঘর্ষে অশান্ত চট্টগ্রামের প্রায় সব শিক্ষাঙ্গন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-চুয়েট, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সহ এই অঞ্চলের প্রায় সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষণে ক্ষণে অশান্ত বা অচল হচ্ছে।
এতে করে শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হাজার হাজার শিক্ষার্র্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। ক্যাম্পাসে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িতদের পেছনে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের মদদ থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর হতে পারছে না প্রশাসন। এতে করে ক্যাম্পাসে শান্তি-স্বস্তি আর শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। পুলিশের সামনেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে ছাত্রলীগ। কোথাও আবার তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যদের উপরও চড়াও হচ্ছে। এতে করে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বিব্রত সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতাদের অনেকে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একে একে এই অঞ্চলের সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের দখলে চলে যায়। ছাত্রশিবিরসহ অন্য ছাত্র সংগঠনের ক্যাম্পাসভিত্তিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একক আধিপত্য নিশ্চিত করে ছাত্রলীগ। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দেয়ার পর নিজেদের মধ্যেই প্রতিপক্ষ তৈরি তারা। এখন প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে রয়েছে ছাত্রলীগ। শিক্ষাঙ্গনকে ঘিরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলের সিট দখল থেকে শুরু করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তারা নিজেদের মধ্যেই সংঘাত-সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে।
ত্রিশ বছর পর গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করার কথা বলে চট্টগ্রাম কলেজে প্রবেশ করে ছাত্রলীগ। এ সময় ছাত্রশিবিরের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনাকে পুঁিজ করে ওইদিনই চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসীন কলেজের সবকটি ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। আবাসিক ছাত্রদের বের করে দিয়ে হলে হলে তালা দেয়া হয়। চকবাজার থেকে পুলিশ ফাঁড়ি সরিয়ে এনে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাস্পাসে বসিয়ে দেয়া হয়। শিবির হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে চট্টগ্রাম কজেলের প্রধান গেইট ছাড়া বাকি সবকটি গেইটে তালা দেয়া হয়। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। এই সরকারের সময় ব্যাপক উন্নয়ন করা হয় প্যারেড ময়দানের। সেখানে প্রতিদিন সকাল-বিকাল অসংখ্য মানুষ ব্যায়াম করতো। কিন্তু ফটকে তালা দেয়ায় সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকাবাসি।
কলেজ দুটি বহিরাগতদের দিয়ে দখলে নেয়ার কিছুদিনের মধ্যে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কলেজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিকে ঘিরে দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এক গ্রুপের কর্মীরা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারি, অপরপক্ষ নগর সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারি হিসাবে পরিচিতি পায়। উভয় গ্রুপ কলেজ দুটিতে অছাত্র এবং বহিরাগতদের সমাবেশ ঘটানোর পাশাপাশি কলেজ এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তুলে। এসব অভিযোগে তারা পুলিশের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ও নালিশ করছে।
প্রথমবর্ষে ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুটি কলেজেই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরমে উঠে। সর্বশেষ রোববার দুই পক্ষ বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কলেজ এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে তারা কয়েক ঘণ্টা পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখে। বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ অনেকে আহত হয়। প্রকাশ্যে উভয়পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়ে। এলাকাজুড়ে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় থানায় মামলা করেছে পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেফতার কিংবা অস্ত্র উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়নি।
দেশের অন্যতম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব-কলহে অশান্ত হচ্ছে। গত সপ্তাহে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় তিনদিন অচল থাকে। কমিটিতে পদ বঞ্চিতরা টানা অবরোধের ডাক দিয়ে শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে রাতের আঁধারে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় পদ পাওয়া আর পদ বঞ্চিত গ্রুপের কর্মীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের চট্টগ্রামে ছুটে আসতে হয়। দুই পক্ষের সাথে কেন্দ্রের নেতারা কথা বলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করেন। তবে ওই ইস্যুতে যে কোন সময় ক্যাম্পাসে ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ রয়েছে। আবার শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক একাধিক গ্রুপ আছে। এসব গ্রুপ উপ-গ্রুপের সংঘাতে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন কর্মীকে জীবনও দিতে হয়েছে। দফায় দফায় বন্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। একই চিত্র চুয়েটেও। সেখানে এখন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। অন্য কোন ছাত্রসংগঠনের প্রকাশ্য কোন তৎপরতা নেই। এরপরও নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। দুই পক্ষের সংঘাত সহিসতায় কয়েকবার বন্ধ হয়েছে চুয়েট।
আধিপত্য বিস্তারের লড়াই বিস্তৃত হয়েছে বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েও। গত বছর একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘাতে প্রাণ হারায় নগর ছাত্রলীগ নেতা সোহেল আহমদ। ওই খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। গ্রেফতার হয়েছে বেশ কয়েকজন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ তৎপর। যথারীতি একটি গ্রুপ মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারি অপর গ্রুপটি আ জ ম নাছির উদ্দীনের মদদ পেয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন