ইনকিলাব ডেস্ক : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান জার্মানিতে আয়োজিত সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী ও এরদোগানপন্থী সমাবেশে ভাষণ দিতে পারেননি। রোববার জার্মানির কলোন শহরে আয়োজিত এ সমাবেশে তার ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু জার্মানির সর্বোচ্চ আদালত ভিডিও লিংকের মাধ্যমে জনতার উদ্দেশে এরদোগানের ভাষণ দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখায় তিনি উক্ত সমাবেশে ভাষণ দিতে ব্যর্থ হন। খবর সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল।
তুরস্কের ইইউ মন্ত্রী ও প্রধান আলোচক ওমর সেলিক টুইটারে বলেন, জার্মান আদালতের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে গেছে। তিনি এ রায়কে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে চরম আঘাত বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, এটা দেখা লজ্জা হয় যে অভ্যুত্থানের মুখে ইইউ একটি প্রার্থী দেশের সাথে সংহতি প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, জার্মানিতে ৩০ লাখ তুর্কি বাস করে। তারা সেখানকার বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু।
তুরস্ক অনেকদিন থেকে ইইউতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি।
এদিকে ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে ব্যাপক গ্রেফতার ও চাকরিচ্যুতির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তুরস্কের সরকারি মিডিয়া জানায়, ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটনায় আটক শত শত সৈন্যকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
খবরে বলা হয়, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর আটক ১০ হাজার ১২ জন সৈনিকের মধ্যে ৭৫৮ জন শনিবার মুক্তি পেয়েছে। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র কার্যকরে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার প্রেক্ষিতে ইস্তাম্বুলের একজন বিচারকের সুপারিশে তারা মুক্তিলাভ করে। বিচারক সামরিক ছাত্রসহ ওইসব সৈনিকের আটককে অপ্রয়োজনীয় বলে আখ্যায়িত করেন।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে জারি করা প্রেসিডেন্টের এক নতুন ডিক্রিতে সন্দেহভাজনদের কোনো অভিযোগ ছাড়াই ৩০ দিন আটক রাখা যাবে। ওই নির্দেশনায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তাদের আইনজীবীদের সাথে কথোপকথন সরকারের শোনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত বার্তা সংস্থা আনাদলু জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মীয় নেতা ফতেউল্লাহ গুলেনের আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ১৩৮৯ জন সামরিক ব্যক্তিকে রোববার তুর্কি সশস্ত্র বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গুলেন এ অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
সরকার রোববার সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে সামরিক বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করার লক্ষ্যে কিছু আদেশ জারি করেছে। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চলছে।
নতুন ডিক্রির আওতায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধানের বদলে সরাসরি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা করবে।
এদিকে বিদ্যমান সকল সামরিক স্কুল ও একাডেমি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নতুন প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সামরিক হাসপাতালগুলো এখন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে।
এরদোগান সামরিক বাহিনী ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে জবাবদিহি করার কথাও ভাবছেন। তবে এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে ও সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা প্রয়োজন।
তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে ২৪৬ ব্যক্তি ও ২৪ জন অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রকারী নিহত হয়েছে। সরকার তার কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কোনো সময় নষ্ট করেনি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করে দ্রুত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন, অন্যদিকে সিএনএনের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এরদোগান পরিষ্কার রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য প্রতিশোধ নেয়ার শপথ ব্যক্ত করেন।
দ্রুত গণগ্রেফতার, আটক ও অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারী বলে সন্দেহভাজনদের বরখাস্ত করে ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়েছে।
যারা অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বলে সন্দেহভাজন তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে ব্যাপক ও বেপরোয়াভাবে। রাষ্ট্রীয় টিভি টিআরটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে জানায়, সর্বমোট গ্রেফতারকৃতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৪৬। তাদের বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাদের সংখ্যা ১০ হাজার ১২, ১৭৮ জনই জেনারেল।
বিনালি ইলদিরিম আনাদলুকে তুরস্কের এলিট প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড ইউনিটকে ভেঙে দেয়ার ইচ্ছার কথাও জানান।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান আংকারায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, তার মানহানি করার জন্য তিনি যেসব মামলা করেছিলেন সেগুলো তুলে নিতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি বলেন, মাইলফলক হিসেবে আমার অবমাননার জন্য সকল মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি ও সকল অপরাধীকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ আইন মেনে চলেছে। এমনকি অভ্যুত্থান চেষ্টার সময়ও আমরা আইনের সাথে বিন্দুমাত্র আপস করিনি। আমাদের গৃহীত সকল পদক্ষেপই নেয়া হয়েছে সংবিধান ও আইনের আওতায়।
সরকার বুধবার বলে, তুর্কি কর্তৃপক্ষ জার্মান পত্রিকার ৪৭ জন সাংবাদিক, ম্যানেজার ও সাবেক কর্মচারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এরদোগানের অফিসের একজন কর্মকর্তা সংবাদপত্রটিকে গুলেন আন্দোলনের মিডিয়া সংস্থার ‘ফ্ল্যাগশিপ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
এটা হচ্ছে গুলেনসহ কথিত অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর সর্বশেষ হামলার ঘটনা। এরদোগান ১৫ জুলাইর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বারংবার গুলেনের নাম উল্লেখ করেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কলামিস্টরা কী লিখলেন বা বললেন সে বিষয়ে প্রসিকিউটররা আগ্রহী নন। এক্ষেত্রে কারণ হচ্ছে যে জার্মানের বিশিষ্ট কর্মচারীরা গুলেনের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তাই তাদের কাছ থেকে তদন্তকারীরা উপকৃত হতে পারেন।
এছাড়া তুর্কি কর্তৃপক্ষ গুলেনের সাথে সম্পর্কিত ২ হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। তার আগে একই ঘটনায় এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে ৪২টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৮৯ জন সাংবাদিকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে তুর্কি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ গুলেনের সাথে সংশ্লিষ্ট ধারণায় ২৪টি রেডিও-টিভি স্টেশনের লাইসেন্স বাতিল করেছে।
এসবের বাইরে তুর্কি কর্তৃপক্ষ কিছু রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৬০ হাজার লোককে বরখাস্ত বা সাময়িক বরখাস্ত করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন