শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আর্থিক খাতের প্রধান ঝুঁকি কু-ঋণ : বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : ঋণ ঝুঁকিকে আর্থিক খাতের প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ সুবিধায় বিপুল পরিমাণের খেলাপিঋণ নিয়মিত করার পরও ব্যাংকিং খাতে অনাদায়যোগ্য (কু-ঋণ) খেলাপিঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে এ খাতে মোট খেলাপিঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশই মন্দমানের বা কু-ঋণ। এর পরিমাণ সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
এই হিসাব গত বছরের ডিসেম্বরের। এক বছর আগে ২০১৪ সাল শেষে এ খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকার মন্দঋণ ছিল। এক বছরের ব্যবধানে মন্দঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। ফিন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৫-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার এর মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এ সময় ডেপুটি গভর্নর, চেঞ্জ ম্যানেজম্যান্ট উপদেষ্টা, সিনিয়র উপদেষ্টা, নির্বাহী পরিচালক, সংশ্লিষ্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
২০১৫ সালে বিশেষ সুবিধায় বিপুল অঙ্কের খেলাপিঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। তারপরও এ খাতে মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণ অনুমোদনে স্বচ্ছতা ও দক্ষতার অভাব, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সর্বোত্তম পরিপালন না কর করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপিঋণের ৩টি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হলো-নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দমান। অর্থাৎ সর্বশেষ ধাপের খেলাপিঋণকে মন্দ বা ক্ষতিজনক বলে ধরা হয়। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এটা ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত। এজন্য এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। অপর দুটি পর্যায়ের মধ্যে সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ ও নি¤œমানের ঋণে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপিঋণ সামান্য কমেছে। ২০১৪ সালে ব্যাংকিং খাতে যেখানে খেলাপিঋণ ছিল ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা সামান্য কমে হয় ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। মোট খেলাপিঋণ কমার পেছনে নি¤œমান ও সন্দেহজনক খেলাপিঋণ ভূমিকা রেখেছে। তবে মোট খেলাঋিণ কমলেও মন্দমানের খেলাপিঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে মন্দমানের খেলাপিঋণ ছিল ৭৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। যা ২০১৫ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। এছাড়া ২০১৪ সালে খেলাপি ঋণের মধ্যে নি¤œমানের ঋণ ছিল ১১ শতাংশ ও সন্দেহজনক ঋণ ছিল ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৫ সালে নি¤œমান ও সন্দেহজনক খেলাপিঋণ কমে হয় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে খেলাপিঋণ পুনঃতফসীল বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল হয়েছে ঝুঁকিভিত্তিক ঋণগুলো। এই হার ২৮ শতাংশ। তবে এ সময়ে মোট ঋণ বিতরণ হওয়া ঋণের সাড়ে ৪ শতাংশ এবং অশ্রেণীকৃত ঋণের ৫ শতাংশ পুনঃতফসীল হয়েছে। ২০১৪ সালে বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, অশ্রেণীকৃত ঋণের ৩ ধমমিক ৮ শতাংশ ও ঝুঁকিভিত্তিক ঋণের ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ পুনঃতফসীল সুবিধায় নিয়মিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে প্রথমবার বিশেষ সুবিধায় বড় ঋণগ্রহীতাদের (৫০০ কোটি টাকার বেশি) খেলাপিঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। এর মধ্যেও ঝুঁকিভিত্তিক ঋণের অংশ বেশি ছিল। যার হার ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া মোট বিতরণকৃত ঋণের ২ দশমিক ৮ শতাংশ ও অশ্রেণীকৃত ঋণের ৩ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৫৬টি ব্যাংকের ২৩টি ব্যাংক শীর্ষঋণ গ্রহীতাদের পুনর্গঠন সুবিধা দেয়। এর মধ্যে ১৭টি বেসরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি ও ১টি বিদেশী ব্যাংক। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়েছে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দিয়েছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ৪৯ দশমিক ৯০ শতাংশ ঋণই রয়েছে ৫ ব্যাংকে। ৬৪ শতাংশ রয়েছে ১০টি ব্যাংকে। এই ১০ ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংক, বেসরকারি ৩ ব্যাংক, বিশেষায়িত ১ ব্যাংক ও বিদেশী ১ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, সার্বিক ব্যাংকিং খাতে সম্পদের ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রনী ও রূপালী ব্যাংসহ ৫টি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। আর ১০টি ব্যাংকের অনুকূলে এই সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিমাণ ৪৬ দশমিক ২০ শতাংশ। এই ১০ ব্যাংকের মধ্যে ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও ৬টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে।
অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো দক্ষ এবং বিনিয়োগবান্ধব করতে খেলাপিঋণ কমানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে আরো জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, দেশে উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বড় অঙ্কের (বৃহদাঙ্ক) ঋণগুলোর নড়রদারিকে অধিকতর জোরালো ও কাঠামোবদ্ধ করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৃহদাঙ্ক ঋণ মনিটরিং সফটওয়্যার (সিডিএলসি) স্থাপন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমি বলেন, বড় ঋণগ্রহীতাদের অনুকুলে বেশি ঋণ কেন্দ্রীভূত এ খাতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই এ ধরনের ঋণ মনিটরিংয়ে সফটওয়্যার (সিডিএলসি) চালু করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, জয়েন্ট লিডার ফোরাম (জেএলএফ) গঠনের মাধ্যমে সিডিএলসিতে রিপোর্টকৃত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণগুলো মনিটরিং করা যেতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন