জোট-জামায়াত প্রসঙ্গে ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য ব্যক্তিগত
স্টাফ রিপোর্টার : ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গুলশানের বাড়ির মামলা বাতিলের রায় বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার সরকারের ‘নীলনকশা’র অংশ বলে মনে করে বিএনপি। গতকাল বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, মওদুদ সাহেবের বাড়ির মামলার রায় প্রমাণ করল তাদের (সরকার) একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেটা যে করেই হোক বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে যদি হয়, তাতেও তাদের এতটুকু দ্বিধা নেই এবং তা তারা করে চলেছে। তারা মামলা-মোকাদ্দমা দিয়ে বিএনপিকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। আমরা সরকারের এই প্রক্রিয়ার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
অবিলম্বে এই ভয়াবহ পথ থেকে সরে গণতন্ত্রে ফিরে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জাতি যখন একটা ভয়াবহ সঙ্কট মোকাবিলা করছেÑউগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্কট, সেই সংকটের মুহূর্তে একমাত্র কাজ হচ্ছে গোটা জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঙ্কটের মোকাবিলা করা, তখন বিরোধী দলকে নির্মূল করার এই প্রচেষ্টা কখনো কোনো শুভ বয়ে আনবে না এবং তা সমস্যার সমাধান করবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের বাড়ি যা তার ভাই মনজুর আহমেদের নামে মিউটেশন (নামজারি) ও ডিক্রি জারি করতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাতিল করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকে ও রাষ্ট্রপক্ষের করা তিনটি আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেন।
পাশাপাশি ওই বাড়ি নিয়ে দুদকের মামলায় অভিযোগ আমলে নেওয়াকে বৈধতা দিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ ও তার ভাইয়ের করা লিভ টু আপিলও সর্বোচ্চ আদালত নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। ফলে মামলাটি বাতিল হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে মওদুদের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলাও আর টিকছে না। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই জরুরি সংবাদ সম্মেলন হয়।
ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ মইনুল সড়কের জিয়াউর রহমানের সরকারের বরাদ্দ দেয়া বাড়ি বাতিলের প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অত্যন্ত সচেতনভাবে ও সুপরিকল্পিতভাবে বিরোধী দল ও মতকে নির্মূল করবার জন্য নীলনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। এরই অংশ হিসেবে তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বেআইনিভাবে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যে বাড়িটি তিনি (খালেদা জিয়া) পেয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাহেবের শাহাদাৎ বরণের পরে। যে বাড়িটি সেনাবাহিনী তাকে বরাদ্দ করেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে।
তিনি বলেন, বিরোধী দলকে নির্মূল করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১/১১-এর পরে যেসব মামলা হয়েছিলো, সেগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরুদ্ধে ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের প্রায় ১০ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কেবল তাই নয়, আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কিছু দুর্নীতির মামলা তুলে নেয়া হলো।
আর বিএনপির সব মামলাকে সচল রাখা হলো। আবার নতুন করে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেয়া হলো। আমাদের দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দেয়া মামলায় জজকোর্টে তিনি খালাস পেয়েছিলেন, সেই মামলায় উচ্চ আদালতে তাকে ৭ বছর সাজা দেয়া হলো। সর্বশেষ ঘটনা ঘটল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যার স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরিসীম অবদান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাড়ির মামলা আপিল বিভাগ। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এটা করেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, সরকারের উদ্দেশ্য একটা বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য, দুর্বল করে দেয়ার জন্য, নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য এই কৌশলগুলো নিয়েছে। এভাবে মামলা-মোকাদ্দমা দিয়ে তারা বিএনপিকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীলনকশায় নেমেছে।
জঙ্গিবাদ দমনের সরকারের কোনো আন্তরিকতা নেই অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন একজন দেশপ্রেমিকের মতো সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সেটাকে সরকার বিদ্রƒপ করছে। তারা এখন জঙ্গিদের ধরার নাম করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। প্রথম দফায় তারা ১৬ হাজার গ্রেফতার করেছে।
তিনি বলেন, গুলশান-শোলাকিয়া-কল্যাণপুরের ঘটনার পর থেকে তারা আবারো বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার শুরু করেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছেÑযাদেরকে পুলিশ ধরছে সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে তাদেরকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করে অথবা আদালতে বিচারে না এনে অধিকাংশকে ক্রসফায়ার অথবা গানব্যাটলের নাম করে হত্যা করা হয়েছে। এই বিষয়গুলোর ফলে জনগণের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, সরকারের কতটুকু আন্তরিকতা আছে সত্যিকার অর্থেই জঙ্গিবাদের শেকড়টা খুঁজে বের করার ও জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ৩৭ বছর এই বাড়িতে বসবাস করছেন। এটা কোনো সরকারি বাড়ি নয়। এটা অস্ট্রিয়ান এক নাগরিকের বাড়ি ছিল। স্বাধীনতার পরে এই বাড়িটি ভুলক্রমে এবানডন্ড বাড়ি হিসেবে সরকার তালিকায় নেয়। পরবর্তীতে সরকার এই ভুলটা স্বীকার করে সেই অস্ট্রিয়ান মহিলাকেই এক টাকা মূল্যে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে। এরপর অস্ট্রিয়ান ভদ্রমহিলা বাড়ি পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। বায়নাপত্র হয়। মওদুদ আহমদের নামে বাড়িটি আদালতে রেজিস্ট্রি হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব মাহবুবে আলম আদালতে বলেছেন যে, উনি (অস্ট্রিয়ান ভদ্রমহিলা) ব্যক্তিগতভাবে অস্ট্রিয়া গেছেন। সেখানে গিয়ে উনি (মাহবুবে আলম) খবর এনেছেন যে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোল্ডার বাড়িটি রেজিস্ট্রি করার কয়েকদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে এই মামলা করে আজকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে তার বাড়ি থেকে বের দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ উনি (মওদুদ আহমদ) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
দেশের জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ির ব্যাপারেও অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণেই উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমি বলব, এটা ঠিক নয়। আইনকে আইনের পথে চলতে দিতে হবে, আদালতকে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য ব্যক্তিগত
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা না রাখা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য ‘ব্যক্তিগত’ বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত মতামত। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সাহেব একটা রিজিওয়ান্ডার দিয়েছেন, স্বব্যাখ্যা আছে সেখানে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এমাজউদ্দীন বলেন, দেশের যে অবস্থা, তাতে জাতীয় ঐক্য করতে একটি রাজনৈতিক দলই বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়। জনগণের যে বিরোধী দল সেই দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২০ দলের মধ্যে এই দলটিকে আর ওইভাবে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
২০ দলীয় জোটের জন্য জামায়াতকে একটি ‘দায়’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকার ও জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ‘চিন্তা ভাবনা’ করতে পারে।
জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে যে আহ্বান আপনারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা জানতে পেরেছি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। আপনারা কি মনে করেন এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারেÑএরকম প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই প্রশ্ন আপনাদের প্রেডিকশন, চিন্তাভাবনার। বাস্তবতা হচ্ছে যে, আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। সেই বাস্তবতায় আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি। এটা করছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে।
এই জাতীয় ঐক্য আহ্বান করেছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান থেকে। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, দেশের সবচেয়ে বিরোধী দলের নেতা তিনি। তার যে জাতীয় দায়িত্ব তার থেকে এই আহ্বান তিনি জানিয়েছেন। এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছি। যখন এটা ফলোপ্রসূ হবে, আপনাদের জানাবো।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবীর খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আবদুস সালাম আজাদ, আবদুল আউয়াল খান, অর্পনা রায়, রফিকুল ইসলাম মাহতাব, হাফেজ আব্দুুল মালেক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন