*যেকোন সময় রিমান্ডে ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দদুলাল
* পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে সিনহা হত্যার তদন্ত
*কক্সবাজারের এসপিকে গ্রেফতারের দাবি আওয়ামী লীগ নেত্রীর
চাঞ্চল্যকর মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি টেকনাফ থানার বহুল বিতর্কিত ও বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপের একটি ব্যক্তিগত ডায়েরির সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই ডায়েরিতে প্রদীপের ২শ’ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ওসি প্রদীপের ডায়েরিতে কিছু ব্যক্তির নামও পাওয়া গেছে, যাদের প্রদীপ বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন। একটি সূত্রে জানা গেছে, ওসি প্রদীপ গত বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা দুবাই ও ভারতে পাচার করেছেন। বিদেশে এই সব টাকা পাচারের জন্য টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু ব্যবসায়ী তাকে সহযোগিতা করার তথ্যও পাওয়া গেছে এতে। এছাড়াও টেকনাফ থানার সামনে দুই দোকানদারের মাধ্যমে প্রদীপ টাকা পাচার করতেন। ওসি প্রদীপ টেকনাফ ছাড়ার পর ওই দু’জন দোকান বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছে।
ডায়েরিতে গত দুই বছরে বিভিন্ন তারিখে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের থেকে নেয়া কোটি কোটি টাকার তথ্যও পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যক্তিকে মাসিক টাকা দেয়ার কথা ডায়েরিতে লেখা আছে।
প্রদীপ তার অপকর্ম প্রকাশ না করার জন্য হাতে রাখতেন টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু সাংবাদিকও। এইসব সাংবাদিকদের প্রদীপ মাসিক মোটা অংকের টাকাও দিতেন। আর তারা প্রদীপের অপকর্ম সাপোর্ট করতেন, বাহবা দিতেন। ওসি প্রদীপের অর্থায়নে কয়েকমাস আগে একটি অনলাইন টেলিভিশন চালু করা হয়। ওই অনলাইন টেলিভিশনকে প্রদীপ নিজের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করতো এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামালা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া র্যাব কক্সবাজারের উপ অধিনায়ক মেজর মেহেদি হাসান জানিয়েছেন, মামলার তদন্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না।
এদিকে, মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপসহ আসামিরা আত্মসমর্পণ ও নানা নাটকীয়তায় ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর এখন কারাগারে রয়েছেন। গত শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে গতকাল দুপুর পর্যন্ত রিমান্ড মঞ্জুরের নির্দেশ আদালত থেকে কারাগারে পৌঁছায়নি। তবে বিকেলে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব বিশেষ ব্যস্থাপনায় আদালতের নির্দেশের কপি কারাগারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। এর পর আদালত যে চারজন আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেননি সেই চারজন আসামিকে র্যাব কর্মকর্তারা গতকাল সন্ধ্যায় জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এছাড়াও ওসি প্রদীপ আইসি লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলালকে যে কোন সময় র্যাব তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানা গেছে। কারাগারে বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপসহ সিনহা হত্যা মামলার আসামিরা বিশেষ নিরাপত্তায় জামাই আদরে রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন।
এদিকে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অপকর্মের কোন শাস্তি হবেনা মর্মে দৃঢ প্রত্যয়ী ছিলেন ভয়ঙ্কর কিলার ওসি প্রদীপ। কিন্তু চট্টগ্রাম হয়ে পার্শ্ববর্তী কোন দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে তিনি ধরা পড়েন চট্টগ্রাম পুলিশের হাতে। বেপরোয়া ওসি প্রদীপ এভাবে তার বাহিনীর হাতে ধরা পড়বেন ভাবেন নি কোনদিন। এতদিন যারা তার এই কুকর্মে সাহস দিয়েছে, বাহবা দিয়েছে কিংবা তার কাছ থেকে মাসোয়ারা নিয়ে তাকে সাপোর্ট করেছে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় এখন কেউ তার কাছে নেই। বর্তমানে তিনি বন্দি কক্সবাজার কারাগারে। যেখানে রয়েছেন তার নির্যাতনে ও তার দেয়া মামলা এবং ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে যাওয়া অসংখ্য বন্দি। সেই মানুষগুলোর সাথেই এখন ওসি প্রদীপ কক্সবাজারের কারাগারের একজন বন্দি। এতে করে মানসিকভাবে খুবই অস্বস্থিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে সেই প্রতাপশালী ওসি প্রদীপ।
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ (সদ্য বরখাস্ত)-এর ক্ষোভের বলি হয়ে ৬টি মিথ্যা মামলায় ১১ মাস ধরে কারাবাস করছেন সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা। করোনাকালে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের পরিবারের দুর্দিন যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে ৩ ছেলে-মেয়ের পড়া লেখা। স্ত্রী, ৩ সন্তান ও বৃদ্ধ মায়ের চরম অভাব অনটনে দিন কাটছে। মামলার খরচ ও সংসারের ঘানি টানতে তারা বিক্রি করেছেন বসতভিটা। প্রতিনিয়ত ভয় তাড়া করছে তাদের। অবাক করা বিষয় হলো ফরিদকে জামিনে কারামুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি তারা। ওসি প্রদীপের ‘ক্রসফায়ারের’ ভয়ে কারাগারকেই নিরাপদ মনে করেছেন ফরিদের পরিবার। এই সাংবাদিকের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য। ফরিদের স্ত্রী হাসিনা মোস্তফা তার স্বামীর মুক্তি ও ওসি প্রদীপের শাস্তি দাবি করেন।
কারাগারে ওসি প্রদীপের জামাই আদরে দিন যাপনের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, ক্ষুদ্ধ কয়েদিদের সাথে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে আসামি ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছে।
এদিকে ওসি প্রদীপ চকরিয়া থানায় দায়িত্ব পালনকালে অন্যায় ভাবে চকরিয়ার প্রখ্যাত কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় হোস্টেলে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের আহত করেছিলেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষ। ওই সময়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্র শিক্ষক ও অভিভাবকরা এখন প্রদীপের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন। মহেশখালীতে দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে ঘুষ বাণিজ্য এবং একজনের জমি আরেকজনকে মোটা অংকের টাকায় দেয়াসহ অনেক অপকর্মের করেছেন ওসি প্রদীপ। সে সময়ে নির্যাতিত মানুষেরা এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ওসি প্রদীপের ঘুষ বাণিজ্য, নিরিহ মানুষকে নির্যাতন, ধরে নিয়ে চাঁদা আদায় ও ক্রসফায়ারে হত্যার নিন্দা জানিয়ে শাস্তি দাবি করেছেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর। তিনি বলেছেন এটি ওসি প্রদীপের বাড়াবাড়ি ও অপকর্মের ফল।
কক্সবাজারের এসপিকে গ্রেফতারের দাবি আওয়ামী লীগ নেত্রীর
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ড ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের গ্রেফতার ও রিমান্ড দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। একইসঙ্গে এসপি মাসুদ হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও পূর্ব অপরাধের বিচার দাবি করেছেন তিনি। শুক্রবার ৬টা ৫ মিনিটে এ দাবিতে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস লেখেন জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী কাবেরী। পাঠকদের কাছে তার স্ট্যাটাসটি হবহু তা তুলে ধরা হলো- কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাসুদ সাহেবকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হউক। যাবজ্জীবন কারাদন্ড চাই। পূর্ব অপরাধেরও বিচার হউক।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে এমন কঠোর স্ট্যাটাস দেয়ার কারণ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেত্রী নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, কক্সবাজার জেলার কোন থানায় টাকা ছাড়া মামলা হয় না। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হয়। মামলার টাকার ভাগ পুলিশ সুপার পান। না হলে তিনি ব্যবস্থা কেন নেন না?
মেজর সিনহা হত্যা ঘটনায় টেকনাফ থানায় পুলিশের করা ২টি মামলায় সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা কেউ ৩১ জুলাই রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন। তারা কেউই মামলায় সাক্ষী দিতে রাজি নয় বলে জানা গেছে। সিনহা হত্যা মামলায় গঠিত তদন্ত কমিটি পুলিশের করা ওই মামলায় সাক্ষীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে এই তথ্য বেরিয়ে আসে বলে জানা গেছে। পরের দিন থানায় ডেকে নিয়ে জোর করে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে বলেও জানান তারা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে সিনহা হত্যার তদন্ত
সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম কর্মপরিকল্পা অনুযায়ী এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমান। তদন্ত দলের প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রথম বৈঠকেই কিছু কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। সেই কর্মপরিকল্পনা নিয়েই আমরা এগুচ্ছি, তদন্তের স্বার্থে যাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার আমরা সেটা করছি।
তিনি বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি, আসল সত্যটা বেরিয়ে আসুক। আমরা আশা করছি সরকারের নির্ধারিত সাত কর্মদিবসের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারব। মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনার পর দিন প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহান আলীকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর একদিন পর শনিবার ২ আগস্ট তা পুনর্গঠন করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে তদন্ত দলের প্রধান করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন