বিশেষ সংবাদদাতা : দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করা গুরুদায়িত্ব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্ষমতা কোনো ভোগের বস্তু নয়, জাতির প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের। তিনি বলেন, কারো কাছে ক্ষমতা হচ্ছে ভোগের বস্তু আর কারো কাছে ক্ষমতা হচ্ছে কর্তব্য পালন করা। আমাদের চিন্তা হচ্ছে, জাতির প্রতি কর্তব্য পালন। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করা। মানুষ যে আমাকে একটা ভোট দিল, তার বদলে সে কি পেল- এটাই তখন বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়।
প্রধানমন্ত্রী মানুষকে সুন্দর আগামীর জন্য স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণের জীবনমান উন্নয়নের যে চেতনা তা জনগণের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে পারলেই দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার তার তেজগাঁও কার্যালয়ে ২০১৬-১৭ অর্থ-বছরের বাষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষকে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে হবে যে, তার জীবনটাও উন্নত হবে, হাহাকার থাকবে না, জীবনমান উন্নত হবে। সব সময় তাদেও ভেতরে একটা চেতনা জাগরুক রাখতে হবে, তবেই উন্নয়নের কাজটা ত্বরান্বিত হবে।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বক্তৃতা করেন। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় এবং সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলমও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে উন্নত করতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই কিন্তু আমাদের রাজনীতি। আমরা নানা ধরনের রাজনীতি অতীতে দেখেছি। কিন্তু যে দলটা একবারে তৃণমূল থেকে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে গঠিত হয় এবং মানুষের জন্য কাজ করতে পারে, ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাদের মানুষের জন্য চিন্তা-ভাবনাটা অন্যরকম থাকে। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলে তাদের চিন্তাটা অন্যরকম। তিনি আরও বলেন, ভোটের অধিকারটাও কিন্তু আমাদের অর্জন করতে হয়েছেÑ অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে। সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কাজেই আমরা সেই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাজ করছি বলেই আজকে যেমন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, মানুষের জীবনমান কিছুটা হলেও উন্নত করতে পেরেছি। আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করেছিলামÑ স্বাধীতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশকে উন্নীত করে আর ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ।
সরকারি অর্থ অপচয় না করে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্প প্রণয়নটা শুধু অর্থ ব্যয়ের চিন্তা থেকেই যেন না হয়। সেখান থেকে কতটুকু দেশের উন্নতি হবে আর এর সুফল মানুষ কতটুকু পাবে সে হিসাবটাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সেই সাথে সাথে আমাদের এই কষ্টার্জিত অর্থÑ এাঁর যেন অপব্যবহার না হয়।
বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ৯০ ভাগ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সক্ষমতা আমরা আর্জন করেছি। এতে আমাদের নিজেদেরও একটা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ অর্থটা আমাদের, এটা যেন অপচয় না হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় প্রচলিত ছিল সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল। এই চিন্তা থেকে দেশের মানুষকে সরিয়ে আনতে হবে। দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে যে, সরকারের মাল হচ্ছে জনগণের। এটা জনগণেরই সম্পদ, জনগণেরই কল্যাণে কাজ হবে, ব্যয় হবে। এটা দরিয়াতে ঢালার জন্য না।
বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জড়িতদের ‘আরেকটু কষ্ট করতে হবে, খাটতে হবে ও শ্রম দিতে হবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসময় গত অর্থ-বছরে সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কাজে আরও ‘গতিশীলতা’ আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষকে আমাদের সকল কাজের সাথে এবং উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করে নিতে হবে। মানুষকে এটা উপলদ্ধি করাতে হবে দেশটা আমাদের, আমাদের এর উন্নয়ন করতে হবে এবং সরকার যাই করছে আগামী প্রজন্ম যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সেই চিন্তা থেকে করা হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন হলে জনগণের উন্নয়ন হবে। জনগণের মাঝে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি ছাড়া কষনও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। আমরা ’৯৬ সালে ৫ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করি এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করি। এর মধ্যে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয়নি। এখন আমরা ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ১০ বছরমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৭ সালে তাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি সেখানে বসেও ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে কখন কীভাবে কাজ করা যেতে পারে, কীভাবে দেশকে একটি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে ভেবেছেন। ছোট ছোট কাগজে তার ভাবনাগুলো লিখে রেখেছেন। আর পরবর্তীতে সেগুলোর ভিত্তিতেই একটি সার্বিক পরিকল্পনার আকাওে তৈরি হয় রূপকল্প-২০২১।
তিনি বলেন, দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার নীতিমালা নিয়েই আমরা সরকার গঠন করি। আমাদের লক্ষ্য একটাই গণতান্ত্রিক সুশাসনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
জাতিসংঘের এমডিজি এবং এসডিজিতে প্রণয়ন করার সময় তার জাতিসংঘে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলÑ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রস্তাবই তখন জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকা- এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের অর্জনকে সকলেই সাধুবাদ দিয়েছে এবং গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। এর আগে যখন দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল তখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল, মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের উন্নয়ন।
যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে তার বাস্তবায়ন করা হলে তা খুব একটা কঠিন হয় নাÑ এ অভিমত ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসার পর দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব। কত সালের মধ্যে কী-কী করব, তা ঠিক করি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, নিরাপত্তা, গ্যাস ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে আমরা গুরুত্ব দিই।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পর থেকেই দেশে শুরু হয় হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে গেলেই যেন বিপদ বেশি হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেজন্যই প্রাণ দিতে হয়েছিল। এমন হত্যার ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আমরা দেশে আরও দেখেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যে সংবিধান দিয়ে গেছেন, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বাজেট বৃদ্ধি করেছি। এতো বিশাল আকারের বাজেট বাংলাদেশে আর কেউ দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ভিক্ষুকের জাতির কোনো ইজ্জত থাকে নাÑ সুতরাং আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হই। পাঁচ বছরে আমরা জনগণকে কতটা সেবা দিতে পারব। আর সেটা অর্জন করাই আমাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। আমাদেও সৌভাগ্য আমরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে পেরেছিলাম। ফলে গত পাঁচ বছরে যে কাজগুলো শুরু করেছিলাম। তা সম্পন্ন করতে পারছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং আমাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার আলোকে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির একটি কাঠামো অনুসৃত হয়ে আসছে। এই পদ্ধতির আওতায় প্রতি বছর প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটি মূলত, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে তার সঙ্গেই চুক্তি করা হয়ে থাকে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মহলকে আন্তরিক হবার পাশাপাশি এটি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থ-বছর নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর হলো। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সিনিয়র সচিব এবং সচিবগণ নিজ নিজ মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০১৫-১৬ অর্থ-বছর থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর সঙ্গেও এই চুক্তি হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন