ইনকিলাব ডেস্ক : জার্মানির ব্রেমেনের অধিবাসী হ্যারি স্যাফ্রো এক সাবেক আইএস যোদ্ধা। তার এক বন্ধুর সাথে ২০১৫ সালে তিনি ইসলামিক স্টেটের সাথে যোগ দিতে সিরিয়া যান। সেখানে তিনি আইএসের গোয়েন্দা ইউনিটের সাথে যোগ দেন। পরে তাকে নিজ দেশের অভ্যন্তেের কাজ করার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। দেশে ফেরার পর তিনি গ্রেফতার হন। তার তিন বছরের কারাদ- দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি নিজ শহর ব্রেমেনের কাছে কারাগারে দ- ভোগ করছেন। স্যাফ্রো সহিংস ব্যক্তি বলে বিবেচিত না হওয়ায় কয়েকদিন আগে তাকে নিঃসঙ্গবন্দী অবস্থা থেকে অন্য বন্দীদের সাথে রাখা হয়েছে। কারাগারে অভ্যন্তরে তার এক বিরল সাক্ষাতকার নেয় নিউইয়র্ক টাইমস। এতে তিনি তার কাহিনী এবং জঙ্গি গ্রুপ আইএসের অভ্যন্তরের অনেক বিষয়কে তুলে ধরেছেন।
জিহাদের পবিত্র আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেÑ এ বিশ্বাসে হ্যারি স্যাফ্রো গত বছর জার্মানির কর্মজীবী মানুষের শহর ব্রেমেনে তার বাড়ি ছেড়েছিলেন। চারদিন একটানা যাত্রায় তিনি পৌঁছেছিলেন সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। তারা পৌঁছনোর পরপরই মুখোশ পরিহিত আইএসের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে ও তার জার্মান বন্ধুকে জানায় যে তারা সিরিয়ায় আর কোনো ইউরোপীয়ের আগমন চায় না। তাই তাদের দেশে ফিরে আসতে হল, তবে শর্ত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী আইএসের সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় সাহায্য করতে হবে।
সোমবার ব্রেমেনের কাছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাধীন কারাগারের অভ্যন্তরে নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে ইংরেজিতে এক সাক্ষাতকারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্যাফ্রো বলেন, আইএসের গোয়েন্দা সদস্য আমাদের সাথে পরিস্থিতি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেন। ইউরোপের দেশগুলোতে তাদের বিপুল সংখ্যক লোক রয়েছে যারা ইউরোপীয় লোকজনের উপর হামলা চালানোর নির্দেশের অপেক্ষা করছে। এটা ব্রাসেলস হামলা, প্যারিস হামলার আগের কথা।
মুখোশধারী ব্যক্তি ব্যাখ্যা করে বলে, কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে আইএস যদিও সুপ্রতিষ্ঠিত, তারপরও বিশেষ করে ব্রিটেন ও জার্মানিতে আরো হামলা চালানো প্রয়োজন। স্যাফ্রো বলেন, তারা আমাকে বলল যে মনে কষ্ট পেও না। তুমি জার্মানিতে ফিরে যাও। এ মুহূর্তে এটাই আমরা চাচ্ছি। তিনি বলেন, তারা সব সময় বলত যে তারা এমন কিছু চায় যা একসাথে ঘটবে। তারা একই সাথে ব্রিটেন ও জার্মানিতে অনেকগুলো হামলা চালাতে চায়।
সন্ত্রাস রফতানি
ইসলামিক স্টেটের গোয়েন্দা ইউনিট ‘এমনি’ নামে পরিচিত। এটি অভ্যন্তরীন পুলিশবাহিনী ও বৈদেশিক কার্যক্রম পরিচালনা শাখার সমন্বয়ে গঠিত। টাইমস পত্রিকার সংগৃহীত ফরাসি, বেলজীয়, জার্মান ও অস্ট্রিয় গোয়েন্দা তথ্য ও জিজ্ঞাসাবাদের হাজার হাজার পৃষ্ঠা দলিলে দেখা যায়, ‘এমনি’র একজন সদস্য বিদেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিতে অঙ্গিকারবদ্ধ।
১৩ নভেম্বরের প্যারিস হামলার ঘটনায় আইএসের বৈদেশিক সন্ত্রাস নেটওয়ার্কের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। বস্তুত এর দু’বছর আগে থেকেই আইএস বিদেশে তাদের যোদ্ধাদের পাঠাতে থাকে। স্যাফ্রো’র বক্তব্য অনুযায়ী এখন অন্যান্য আটক আইএস সদস্যের বাইরেও গ্রুপের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন দেশে সহিংসতা চালাতে সক্রিয় রয়েছে।
বহুমুখী গোয়েন্দা বিভাগটি ইসলামিক স্টেটের সর্বাপেক্ষা ঊর্ধ্বতন সিরীয় সদস্য, মুখপাত্র এবং প্রচারণা প্রধান আবু মুহাম্মদ আল আদনানির অধীনে রয়েছে। স্যাফ্রো’র মতে, তার নিচে রয়েছে অধীনস্থ কর্মকর্তাদের একটি স্তর যারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলার পরিকল্পনা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। যেমন ইউরোপ বিষয়ক গোয়েন্দা বিভাগ, এশিয়া বিষয়ক গোয়েন্দা বিভাগ ও আরব বিষয়ক গোয়েন্দা বিভাগ।
বিদেশে সন্ত্রাস রফতানিতে নিয়োজিত ইসলামিক স্টেটের একটি বিশেষ ইউনিট পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১০টি ভয়াবহ হামলা পরিচালনা বা সমন্বয় করে। এ গ্রুপের পক্ষে কর্মরত ৩০ ব্যক্তিকে তারা কোনো হামলা চালানোর আগেই গ্রেফতার করা হয়।
সাক্ষাতকার ও দলিলপত্র থেকে এ ইঙ্গিতই মেলে যে আইএসের কর্মকা-ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিচালনা করে ‘এমনি’। এ ইউনিটটি গ্রুপের সকল শাখার জন্য লোক নিয়োগ করে এবং তাদের সংস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্টন করে নবাগত থেকে শুরু করে রণাঙ্গনের পোড় খাওয়া যোদ্ধা এবং গ্রুপের বিশেষবাহিনী থেকে এলিট কমান্ডো ইউনিট পর্যন্ত এর আওতাধীন। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ততথ্য থেকে দেখা যায়, জাতীয়তার ভিত্তিতে সদস্যদের নির্বাচন করা হয় এবং ভাষার ভিত্তিতে ছোট, পৃথক ইউনিট গঠন করা হয় যাদের সদস্যদের কোনো কোনো সময় বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে একে অপরের সাথে সাক্ষাত হয়ে থাকে।
আদনানির সমন্বিত ভূমিকার মাধ্যমে গ্রুপের ব্যাপক প্রচারণা কর্মকা-ের সাথে সন্ত্রাসী পরিকল্পনা হাতে হাতে চলে যায়। স্যাফ্রো’র তথ্যমতে, এসব কর্মকা-ে উৎসাহিত করার জন্য মাসিক বৈঠকে আদনানি যুদ্ধক্ষেত্রের নিষ্ঠুর দৃশ্য সম্বলিত ভিডিও প্রদর্শন করা পছন্দ করেন।
এ পর্যন্ত আটক সদস্যদের বক্তব্যমতে, আইএসের সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে ‘এমনি’ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরাই প্যারিস হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং ব্রাসেলস টার্মিনাল ও সাবওয়ে স্টেশনে হামলায় ব্যবহৃত স্যুটকেস বোমা তারাই তৈরি করেছিল। তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, আইএস যোদ্ধাদের অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্পেন, তিউনিসিয়া, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা একের পর এক হামলার সম্মুখীন হয়েছেন সেগুলোর হামলাকারীদের মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই বলে মনে হলেও তারা সবাই আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কারেছে। স্যাফ্রো বলেন, তাদের মধ্যে সংযোগের বাইরে আরো কিছু থাকতে পারে যা কর্তৃপক্ষের এখেেনা জানা নেই। তিনি বলেন, তাকে বলা হয়েছিল যে ইউরোপের গোপন সদস্যরা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মাধ্যম বা নির্দোষ মানুষ হিসেবে ব্যবহার করে। তারা হামলাকারী সদস্যদের সাথে অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে এবং তাদেরকে কিভাবে একটি সুইসাইড ভেস্ট তৈরি করতে হবে ও তাদের হামলার কৃতিত্ব ইসলামিক স্টেটকে দিতে হবে সে বিষয়ে সকল তথ্য সরবরাহ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও একজন ঊর্ধ্বতন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার মতে, আইএস শত শত যোদ্ধাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং এক তুরস্কেই আরো শত শত যোদ্ধা পাঠিয়েছে।
স্যাফ্রো এ বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, সিরিয়া থেকে বহু লোক ফিরে এসেছে, শত শত তো বটেই।
নিয়োগপ্রাপ্তদের বাছাই
আইএসে নতুন যোগদানকারীদের সিরিয়ায় প্রথমে একটি ডরমিটরি নেটওয়ার্কে রাখা হয় যেগুলো তুরস্ক সীমান্তের ঠিক ওপারেই অবস্থিত। সেখানে নবাগতদের সাক্ষাতকার গ্রহণ ও পরীক্ষা করা হয়।
স্যাফ্রো বলেন, প্রথমে তার আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়। তারপর একজন ডাক্তার আসেন তার রক্তের নমুনা নিতে ও তার শারীরিক পরীক্ষা করতে। ল্যাপটপসহ এক ব্যক্তি তার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার নেন। তিনি মামুলি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন: নাম কি? দ্বিতীয় নাম কি? মায়ের নাম কি? মায়ের আসল দেশ কোথায়? কি বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন? আপনার ডিগ্রি কি? আপনার জীবনের লক্ষ্য কি? আপনি কি হতে চান?
তার পিছনের ইতিহাস অবশ্য আগ্রহব্যঞ্জক। তিনি ব্রেমেনে উগ্রপন্থীদের একটি মসজিদে নিয়মিত যেতেন। ঐ এলাকার জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী সমন্বয়কারী ড্যানিয়েল হেইনকের মতে, ঐ মসজিদটি সিরিয়াতে প্রায় ২০ জন যোদ্ধা প্রেরণ করে যাদের মধ্যে ৪ জন যুদ্ধে নিহত হয়। একটি সুপারমার্কেট সেফ ভেঙ্গে ২৩ হাজার ইউরো চুরি করার জন্য তিনি দ-িত হয়ে এক বছর কারাগারে ছিলেন। ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় চুরির শাস্তি কব্জি কর্তন। তবে কারো অপরাধময় অতীত তাদের কাছে মূল্যবান। বিশেষ করে তারা যদি জানতে পারে যে সংগঠিত অপরাধীচক্রের সাথে তার যোগাযোগ আছে, তাহলে সে একটি ভুয়া পরিচয়পত্র যোগাড় করে নিতে পারবে কিংবা ইউরোপে কোনো সংযোগকারী আছে যে তাকে চোরাচালান করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে নিয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি আইএসের দখলমুক্ত বিদেশী যোদ্ধাদের প্রথম আশ্রয়স্থল সিরিয়ার মানবিজশহর থেকে উদ্ধারকৃত ইউএসবি ড্রাইভ দেখার পর আমেরিকান কর্মকর্তারা এ সাক্ষাতকার পদ্ধতির আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন।
সিরিয়া পেঁছনোর তৃতীয় দিনে ‘এমনি’ সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসেন। স্যাফ্রো সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখোশধারী গোয়েন্দা সদস্যরা জানায় যে তার ব্যাপারে আপত্তি আছে।
গত বছর গ্রেফতার হওয়ার পর জার্মান কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভাষ্য অনুযায়ী স্যাফ্রো বলেছিলেন যে তারা আমাকে বলে যে জার্মানিতে লড়াই করার মত বেশী লোক আমাদের নেই। আগে যাও বা দু’একজন ছিল একের পর এক সবাই ধরা পড়েছে। এখন কেউ সেখানে কাজ করতে চায় না। ইংল্যান্ডের মতই সেখানকার অবস্থা।
এর বিপরীতে ফ্রান্সে আইএসের অনেক বেশী সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী ছিল। আমার বন্ধু তাদের ফ্রান্সের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা হাসতে শুরু করল। সে হাসি এত প্রচ- ছিল যে তাদের চোখে পানি বেরিয়ে আসে। পরে তারা বলে, ফ্রান্স নিয়ে চিন্তা কর না। তারা আরবিতে বলল, মাফি মুশকিলাহÑ অর্থাৎ কোনো সমস্যা নেই। ২০১৫-র নভেম্বরে প্যারিস হামলার সাত মাস আগে এ কথাবার্তা হয় তাদের সাথে।
স্যাফ্রো’র কিছু কথার সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে বেশীরভাগ কথাই সত্য। অন্য বন্দীদের সাথে তার কথা মিলিয়ে দেখা হয়েছে। কারা কর্মকর্তা ও স্যাফ্রোকে জিজ্ঞাসাবাদকারী জার্মান গোয়েন্দা এজেন্টদের মত হচ্ছে তার কথা বিশ্বাসযোগ্য। Ñসূত্র নিউইয়র্ক টাইমস। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন