করোনায় জাপানের নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা লেগেছে মেট্রোরেলে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে উত্তরা-মতিঝিল রুটের মেট্রোরেলে। চলমান সাত প্যাকেজের কোনোটিরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রগতি হয়নি। এজন্য প্রকল্পটির বিভিন্ন প্যাকেজের বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জাপানী বিশেষজ্ঞরা দেশে আটকে পড়ায় নির্মাণকাজের গতি ফেরাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে, মেট্রোরেলের যাত্রীসেবা দেয়ার জন্য কেনা হচ্ছে ২৪ সেট ট্রেন। ট্রেনগুলো সরবরাহ করবে জাপানের কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশি কনসোর্টিয়াম। বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য এরই মধ্যে এক সেট ট্রেন প্রস্তুত করেছে প্রতিষ্ঠান দুটি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ট্রেনটি আনার উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে নিয়োজিত ঠিকাদার ও পরামর্শকদের একটি অংশ দেশে ফিরে গেছেন। অপর অংশও কাজ করতে চাচ্ছে না। এছাড়া করোনার কারণে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ট্রেন বিদেশ থেকে শিপমেন্ট হচ্ছে না। এতে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
ফাস্ট ট্র্যাক কমিটিতে পাঠানো প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত অর্থবছর প্রকল্পটিতে বরাদ্দ ছিল সাত হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় সংশোধিত বরাদ্দ কমিয়ে চার হাজার ৩২৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা করা হয়। যদিও ব্যয় হয়েছে মাত্র তিন হাজার ৩৭১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। নির্মাণকাজ বিলম্বের কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী করোনা প্রাদুর্ভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবলের একাংশ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং অপর একাংশ করোনা পরিস্থিতিতে কাজে অংশগ্রহণে অনাগ্রহী। এছাড়া বিদেশি প্রস্তুতকৃত মালামাল, যন্ত্রপাতি ও ট্রেন সেট করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে শিপমেন্ট হচ্ছে না।
প্রকল্পটির সমস্যাবলি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জাপানি নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবল প্রকল্প এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে নির্মাণকাজ পুরোদমে চালু রাখতে হলে দেশি-বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবলকে একত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে হবে। এজন্য সবার কভিড-১৯-এর রিয়েল টাইম পিসিআর টেস্ট করতে হবে। প্রকল্পে এ ধরনের কোনো সংস্থান ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় নিজস্ব উদ্যোগে স¤প্রতি কভিড-১৯-এর রিয়েল টাইম পিসিআর টেস্ট শুরু করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যাদের পিসিআর টেস্ট পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই মর্মে জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় ছোট আকারে কয়েকটি ১০ থেকে ১৫ বেডের ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে বিধায় যাদের পিসিআর টেস্ট নেগেটিভ হবে তাদের প্রকল্প এলাকায় গ্রুপ আইসোলেশনে রাখতে হবে। এজন্য বিদ্যমান অবকাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড কোম্পানি লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনার কারণে জাপানের নিষেধাজ্ঞা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। ৩৪টি দেশে জাপানি নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকল্প এলাকার কাজ জাপানে বসে মনিটরিং করবে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আশা করা হচ্ছে এতে কাজের গতি বাড়বে।
অন্যদিকে, ছয়টি যাত্রীবাহী কোচ সংবলিত মেট্রোরেলের প্রথম সেট ট্রেনের নির্মাণকাজ শেষ হয় চলতি বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। জাপানে আরো চার সেট ট্রেনের কাজ চলমান। চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ সেট ট্রেন বাংলাদেশে সরবরাহ করবে কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশি। বাকি ১৯ সেট ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে। দাম, শুল্ক ও ভ্যাট মিলে ২৪ সেট ট্রেন বাংলাদেশে আনতে খরচ হবে ৪ হাজার ২৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে এক সেট ট্রেনের দাম পড়ছে ১৭৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, মেট্রোরেলের ২৪ সেট ট্রেন সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট জাপানি প্রতিষ্ঠান কাওয়াসাকি ও মিৎসুবিশির সঙ্গে চুক্তি করে ডিএমটিসিএল। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় প্রকল্পের বাস্তব কাজ। আর ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি জাপানে শুরু হয় ট্রেনের বগি তৈরির কাজ। যাত্রীবাহী কোচ (কার বডি) তৈরির কাজ শুরু হয় একই বছরের এপ্রিলে।
কর্মকর্তারা জানান, কাওয়াসাকি-মিৎসুবিশির তৈরি করা ট্রেনগুলো চলবে দেড় হাজার ভোল্টের ডিসি বিদ্যুৎপ্রবাহে। যাত্রীবাহী কোচগুলোর বডি স্টেইনলেস স্টিলের। দুই পাশে বসার জন্য থাকবে লম্বালম্বি আসন। প্রতিটি বগিতে থাকছে চারটি দরজা। একেকটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৩৮ জন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। মেট্রোরেলের ট্রেনগুলো হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের ট্রেনগুলো কেমন হবে, তার একটা ধারণা দিতে এরই মধ্যে দেশে আনা হয়েছে একটি ‘মক আপ’ ট্রেন। উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মেট্রোরেল ডিপোর এক্সিবিশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারে ‘মক আপ’ ট্রেনটি স্থাপন করা হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন