‘হাওর-বাঁওড় মাছে ভরা, কিশোরগঞ্জের পনির সেরা।’ এই স্লোগানেই ফুটে ওঠে হাওর বেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ মাছের বাইরেও পনিরের আলাদা ঐতিহ্য। হাওরের রাণীখ্যাত উপজেলা অষ্টগ্রামের সুস্বাদু সাদা পনিরের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। দেশের সর্বোচ্চ স্থান বঙ্গভবন-গণভবন থেকে শুরু করে সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত প্রশংসা হয় এর স্বাদের।
এদিকে সরকারও কিশোরগঞ্জকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত করার জন্য ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে হাওড় বিধৌত অষ্টগ্রামের পনিরকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠিক কবে থেকে এ জনপদে অতি সুস্বাদু পনিরের উৎপাদন ও বিপণন শুরু হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য কারো কাছ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে যতদূর জানা যায়, এ দেশে আসা পাঠান-মোগলদের একটি দল অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ছাউনি গাড়ে। ওই সময় বিস্তীর্ণ হাওর ঘাসে সবুজ হয়ে থাকত। ফলে অষ্টগ্রাম ও আশপাশের বড় হাওরে স্থানীয়রাসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা মহিষ চরাতেন।
একদিন কাস্তুলের ছাউনির কোনো এক মোগল পাঠান বড় হাওরে গিয়ে গরু-মহিষের পাল দেখে বিস্মিত হন। পাশাপাশি তার চোখে পড়ে দুধের বিপুল উৎপাদন। এভাবে ওই সেনাসদস্য একদিন নিজের অজ্ঞাতেই স্থানীয়দের সাথে দুধের ছানা দিয়ে একধরনের নতুন খাবার তৈরি করে বসেন। পরে এর নাম রাখা হয় ‘পনির’। আবার অনেকে মনে করেন, এ খাবারের নামকরণ হয়েছে মোগলদের উত্তরসূরি কোনো এক দেওয়ান ‘পনির খাঁ’র নামানুসারে।
এছাড়াও হাওর সম্পর্কে প্রচলিত আছে, ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’। কেবল যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে সে সময়ে উদ্বৃত্ত দুধ বাজারজাত করতে না পেরে নদীতে ফেলে দিতে হতো। সে কারণেই হয়তো পনির তৈরির মাধ্যমে দুধ সংরক্ষণের বিষয়টি কারও মাথায় আসে।
যেভাবে তৈরি হয় পনির : একটি বড় পাত্রে দুধের সঙ্গে টক পানি ও সাধারণ পানি রাখা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে জমতে শুরু করে দুধ। পরবর্তী ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে তা রূপ নেয় পনিরে। বাঁশের তৈরি টুকরিতে (ডাইস) সেই পনির ছোট ছোট অংশে রাখা হয়। তখন পানি ঝরতে থাকে পনির থেকে। পানি পড়া শেষ হলে ছোট ছোট ছিদ্র করে লবণ দেওয়া হয় পনিরে। পনির দীর্ঘ সময়ের খাবারে পরিণত করার জন্য দরকার এই লবণের। ১০ লিটার দুধে তৈরি হয় মাত্র ১ কেজি পনির।
পনিরের ব্যবহার : পনির মিষ্টান্ন নয়, কিন্তু উপাদেয়। যা দানাদার এবং স্বাদ নোনতা। একসময় হাওরবাসীর সকালের নাশতায় পনির থাকত। সেকালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে পনির পরিবেশন করা হতো। বাড়িতে আসা অতিথিদের গরম ভাতের সঙ্গে দেওয়া হতো কুচি কুচি করে কাটা পনির। আর ভাঁপ ওঠা চিতই পিঠার ওপরভাগে পনিরের টুকরো দিয়ে দিলে হয় অতুলনীয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পনিরের পরিচয় ভিন্নভাবে। আজকাল পিৎজা, বার্গার বা হরেক রকম বিস্কুটে পনির দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমুচা, পরোটা বা সালাদেও পনির দেওয়ার চল হয়েছে অধুনা।
যেখানে পাওয়া যায় পনির : ঢাকার বহু এলাকায় তাজা বা কাঁচা পনির মেলে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অনেক স্থানেই রাস্তার মোড়ে পনির বিক্রি হয়। অলিগলিতেও অনেকে ফেরি করে পনির বিক্রি করেন। ফেরিওয়ালারা হাঁক দিয়ে বলেন, ‘রাখবাইন অষ্টগ্রামের পনির!’ স্থান ভেদে প্রতি কেজি পনির বিক্রি হয় ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দরে।
ব্যবসায় নানা সঙ্কট : দুধের দাম, হাওরে চাইল্যাঘাস ও গাভীর অভাব পনির ব্যবসায়ী কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেছেন স্থানীয়রা। আবার আধুনিক যুগে ট্রাক্টরের ব্যবহার বৃদ্ধি, গরু-মহিষের চাহিদা অনেকটা কমে যাওয়াও পনির ব্যবসায়ী কমে যাওয়ার বিশেষ কারণ। পনির তৈরি ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ অষ্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে গিয়ে ব্যবসা করছেন। সরকারি সহায়তা পেলে এই এলাকায় পনিরের ঐতিহ্য আবারো ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন