বিশেষ সংবাদদাতা : গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে ভেতরে ও বাইরে সমভাবে জোড়ালো প্রতিবাদের মুখে পড়েছে গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো। গতকাল (রোববার) রাজধানীর টিসিবি মিলনায়তনে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) এর দেয়া গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিকালে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
গতকাল গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদে টিসিবি ভবনের সামনেই বিক্ষোভ সমাবেশ করে গণসংহতি আন্দোলন। সেখানে গণসংহতি নেতৃবৃন্দ বলেন, সাধারণ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের পকেট কেটে এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা চলবে না। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মানা হবে না, মানবো না ইত্যাদি স্লোগানও দেয়া হয় ওই সমাবেশে। এদিকে বাইরে যখন গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বিক্ষোভ চলছিল, তখন ভেতরে শুনানিতে অংশ নেন সংগঠনটির সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি।
এছাড়াও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব-এর পক্ষ থেকেও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর তীব্র আপত্তি জানানো হয়েছে। তারা বলেন, যে কোম্পানি মুনাফা করছে (জিটিসিএল) তার গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। তারা আরও বলেন, উচ্চমূল্যে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এলএনজি আরও দুই বছর পরে আসবে। আর এখনই দাম বাড়ালে তার দায়ভার জনগণ বইবে না।
তবে গ্যাস সঞ্চালনে ৮৯ শতাংশ চার্জ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)’র কারিগরি কমিটি। কমিটির এই সুপারিশকে একেবাবেই অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বর্তমানে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালনে জিটিসিএল ১৫ পয়সা চার্জ নেয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এই সঞ্চালন চার্জ বাড়িয়ে ২৯ পয়সা করার সুপারিশ করা হয়েছে। গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি চার্জ বাড়ানোর সুপারিশ সম্বলিত মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
শুনানি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ এনাজি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান এন আর খান, সদস্য মাকসুদুল হক ও রহমান মুর্শেদ।
জিটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব সারওয়ার, পরিচালক (অর্থ) শরিফুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি উপস্থান করেন। অন্যদিকে ভোক্তাদের পক্ষে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাতলুব আহমেদ, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলমসহ বিভিন্ন পেশা ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ না বাড়ানোর পক্ষে মতামত উপস্থাপন করেন।
গণশুনানিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম বলেন, যে কোম্পানি মুনাফা করছে তার গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। সাধারণ মানুষের উপর এর সরাসরি প্রভাব না পড়লেও বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। যার পরোক্ষ দায়ভার গ্রাহকদেরই ঘাড়েই চেপে বসবে। গ্যাসের পাইকারি দাম নির্ধারণের পরেই সঞ্চালনের চার্জ নির্ধারণ করা উচিত বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।
ড. এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড এখনই লাভ করছে। দাম বাড়ানোর যুক্তির সঙ্গে আয় ও ব্যয়ের সমন্বয় থাকা দরকার। এখানে তা নেই। সমন্বয় করলে চার্জ বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। জিটিসিএল-এর একজন চাকুরিজীবী বছরের ৪ লাখ টাকা বাড়তি বোনাস নিচ্ছেন। যে কোম্পানি একজন চাকুরিজীবীকে এই পরিমাণ বোনাস দিচ্ছে তার মুনাফা বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এজন্য লাভে থাকা কোম্পানির গ্যাস সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, গ্যাস সঞ্চালনে জিটিসিএল যে পরিকল্পনা করেছে তাও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। গ্যাস নেই অথচ সঞ্চালন লাইন হচ্ছে একটার পর একটা। এটা বাস্তবসম্মত নয়। এটা অযৌক্তিক।
এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, উচ্চমূল্যে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এলএনজি আরও দুই বছর পরে আসবে। আর এখনই বাড়ালে তার ভার জনগণ বইবে না।
গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে ভেতরে ও বাইরে তীব্র আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিআইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, সব পক্ষের মতামত আমলে নিয়েই এই দাম ঠিক করা হবে।
এদিকে, জিটিসিএল-এর প্রস্তাব মূল্যায়ন করে বিআইআরসি কারিগরি কমিটি জানিয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থ-বছরে জিটিসিএল-এর রাজস্বের পরিমাণ চার হাজার ২৬৯ দশমিক ১৫ মিলিয়ন টাকা। মোট রাজস্বের চাহিদা সাত হাজার ৪৩৪ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টাকা। এই রাজস্বের চাহিদা অনুযায়ী জিটিসিএল-এর খরচ দাঁড়ায় প্রতি মিটারে ৩২ পয়সা।
গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ী, গ্যাসের দাম গড়ে ৮৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৪০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এর পরেই ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে ১৩০ শতাংশ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর এই শুনানি চলবে আগামী ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। আজ সোমবার বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য হার নিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়াও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাব নিয়ে শুনানি হবে ১০ আগস্ট, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাব নিয়ে ১১ আগস্ট, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাব নিয়ে ১৪ আগস্ট, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের প্রস্তাব নিয়ে ১৬ আগস্ট ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাব নিয়ে ১৭ আগস্ট শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর গ্যাসের বাল্ক মূল্যহার নিয়ে ১৮ আগস্ট পেট্রোবাংলা, বিজিএফসিএল, এসজিএফএল ও বাপেক্সের আবেদনের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
গ্যাসের আপস্ট্রিম খরচ, সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ এবং ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে গত ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল সময়ের মধ্যে আবেদন করে ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। ৩০ মার্চ গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ পুনঃনির্ধারণের জন্যও আবেদন করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। এসব প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে এ গণশুনানির দিন ধার্য করে কমিশন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন