স্টাফ রিপোর্টার : আইনি স্বাধীনতা থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রমে জনগণের আস্থা কম। রাজনৈতিক হয়রানির জন্য দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে মানুষের ধারণা রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রোববার সকালে ধানমন্ডিতে টিআইবির সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ পর্যালোচনা প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুই গবেষক শাহজাদা এম আকরাম ও শাম্মী লায়লা ইসলাম। ‘দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ উদ্যোগ: বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর পর্যালোচনা’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, টিআইবির ১০০ ভিত্তিক সূচকে ‘আইনি স্বাধীনতা ও মর্যাদা’শীর্ষক ক্ষেত্রে দুদকের স্কোর সর্বোচ্চ ৭৮.৫৭। আর সর্বনি¤œ স্কোর এসেছে দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের আস্থার ক্ষেত্রে; মাত্র ২৮.৫৭।
শাহজাদা আকরাম জানান, আইনি স্বাধীনতা ও অবস্থান; অর্থ ও মানবসম্পদ; অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম; প্রতিরোধ, শিক্ষা ও আউটরিচ কার্যক্রম; অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুদকের সহযোগিতা; জবাবদিহিতা ও তদারকি এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের ধারণার মতো সাতটি ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনালের ৫০টি নির্দেশকের আলোকে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সার্বিক স্কোর ৬৭ থেকে ১০০-এর মধ্যে হলে ‘উচ্চ’, ৩৪ থেকে ৬৬ এর মধ্যে হলে ‘মধ্যম’ এবং শূন্য থেকে ৩৩ হলে তাকে ‘নিম্ন’ মানদ-ের বিবেচনা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে স্কোর ৬১ দশমিক ২২ শতাংশ হওয়ায় টিআইবির বিবেচনায় দুদককে একটি ‘মধ্যম মানের’ প্রতিষ্ঠান বলা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “অবস্থান মধ্যম পর্যায়ের, মানে আমাদের গ্লাসটা হাফফুল, খালি বলব না। ২১টি সূচকে আমরা উচ্চ স্কোর পেয়েছি। অনেক আশার সঞ্চার করার সুযোগ আছে। ২৮টি সূচকে হয় মধ্যম, নয় নিম্ন। একদিক থেকে আশাবাদ ও উদ্বেগের প্রতিফলন দেখতে পাই।”
সাধারণের ‘আস্থার সঙ্কটের’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মানুষের যে ধারণা দুদক সম্পর্কে, সেটা খুবই কম, ২৮ শতাংশ। কারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণাটা পৌঁছেনি যে দুর্নীতি করলে মানুষ শাস্তি পায়, উচ্চ পর্যায়ের কেউ দুর্নীতি করলে তাদের শাস্তি দেয়া হয়।” “দুদকের আইন আশার সঞ্চার করে, দুদক যদি সেটা কার্যকর করে তাহলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সম্ভব। এই বার্তাটি মানুষের কাছে পৌঁছেনি। তার মানে মানুষের ধারণা অনুযায়ী দুদক আস্থার জায়গাটা অর্জন করতে পারেনি।” টিআইবির নির্বাহী পরিচালকের মূল্যায়নে দুদকের আইনি কাঠামো ‘খুবই ভালো’। এ আইন নিয়ে ইতিবাচকভাবে আরও কাজ করা সম্ভব। “কিন্তু সেটার যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘাটতি আমরা দেখতে পেয়েছি, সেটা মানুষের ধারণায় প্রতিফলন ঘটেছে।”
গবেষক আকরাম বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত এই গবেষণায় দুদকে অভিযোগকারী বা দুর্নীতির তথ্যদাতাসহ জনগণের ‘অভিগম্যতা’ বিষয়টি নিম্ন স্কোর পেয়েছে। টিআইসহ অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশে দুর্নীতির উচ্চ হারের চিত্র পাওয়া গেলেও দুদকে অভিযোগ আসে বছরে গড়ে ৯ হাজার ৮১০টি, যা জনসংখ্যার হিসাবে মাত্র শূন্য দশমিক ০০৬ শতাংশ। টিআইবি মনে করছে, অভিগম্যতা এবং তথ্যদাতার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিই এর কারণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের তদন্ত করা মামলায় দ-াদেশের গড় হারও নি¤œ পর্যায়ের। গত তিন বছরে গড়ে ৩৭ শতাংশ মামলায় দ-াদেশ হয়েছে। টিআইবি বলছে, সম্পদ আটক ও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে দুদকের সক্ষমতা ‘মধ্যম পর্যায়ের’।
দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর দেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার আর্থিক পরিমাণ জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। টিআইবির গবেষক আকরাম বলেন, “দুদক প্রেসিডেন্টের কাছে দায়বদ্ধ; কিন্তু এর কার্যক্রম তদারকির জন্য কোনো তদারক কমিটি নেই।”
জবাবদিহিতার জন্য ‘স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা’ চালুর সুপারিশ করে গবেষক শাম্মী লায়লা ইসলাম বলেন, “কাজের মূল্যায়ন, তদারকি ও পরামর্শ প্রদানের জন্য উচ্চমাত্রার সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন জনপ্রতিনিধি, বর্তমান বা সাবেক আমলা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে।” অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে দুদকের স্কোর ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা সার্বিক স্কোর থেকে কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “এই ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ, দুর্নীতির অভিযোগকারীর অভিগম্যতা, কম শাস্তির হার এবং দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে জেন্ডার চিহ্নিত না করার বিষয়গুলোতে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।” টিআইবির বিচারে আর্থিক সক্ষমতা ও মানবসম্পদের দিক দিয়ে দুদকের স্কোর ৭২.২২, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুদককে ১০০ তে ৭০ দেয়া হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাজেটের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, দুদক থেকে যে বাজেট দেয়া হয়, সেটা মোটামুটিভাবে অনুমোদিত হয়। বাজেট ক্রমান্বয়ে বাড়ছেও। বাজেট বাড়া ইতিবাচক আবার সেটা অপ্রতুলও।
“দেখা গেছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে তাদের তদন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের আউটরিচ প্রকল্প যেটা সেটা ঠিকমত হচ্ছে না। কাজেই আমরা বাজেট বৃদ্ধি করার সুপারিশ করছি।”
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, “আজ যে প্রতিবেদন পেলাম, সেটা অনেক দিনের মধ্যে বোধহয় আমাদের নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রচ- একটা নেতিবাচক অবস্থান আমরা দেখতে পাইনি। অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। সে নির্দেশনা থেকে সামনে তাকানোর সুযোগ রয়েছে। এটা আমাদের আশাবাদী করছে।”
রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি দমনের কাজটিকে যেখানে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, সেখানে বাজেটের অপ্রতুলতা কেন থাকবেÑ সেই প্রশ্ন তোলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই সাবেক উপদেষ্টা।
অন্যদের মধ্যে টিআইবির গবেষণা পরামর্শক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান, টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া খায়ের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন