মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মুসলিম জীবনে হজ

প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আসাদুজ্জামান আসাদ
প্রতি বছর হজের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলিম জাতি আরাফাত ময়দানে একত্রিত হবার সুভাগ্য অর্জন করে থাকেন। জিলহজ মাসে আরাফার ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতি মায়ামমতা, ভ্রাতৃত্ববোধে জাগ্রত হয়ে থাকেন। একে অপরের খোঁজখবর নেয়ার সুভাগ্য অর্জন করেন। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান পরস্পর পরস্পর ভাই ভাই’।
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। যা আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। ‘যে ব্যক্তি হজ সম্পাদন করল, সেই ব্যক্তি বড়ই ভাগ্যবান। হজের মাধ্যমে সে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করল, যে ব্যক্তি সুভাগ্যবান। সেই ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তাআলা হজ পালন করার তৌফিক দান করেন’। তাছাড়া হজ নেসাব পূর্ণ প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ নয়। সম্পদশালী ব্যক্তির নিকট যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পূর্ণ থাকে তাহলে জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ সম্পাদন করল এবং কোনো প্রকার অন্যায় ও গুনাহের কাজ করল না সে বাড়ি প্রত্যাবর্তনকালে এমন নিষ্পাপ হয়ে ফিরল যেন সে এই মাত্র তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হলো।’ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হজ পালন করা ফরজ। এরশাদ হচ্ছে- ‘মানুষের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি কাবা শরীফ গমন করার সামর্থ্য রাখে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার ওপর হজ করা একান্ত কর্তব্য’ (সুরা ইমরান)। অন্য জায়গায় বলা হচ্ছে- ‘মানুষের মাঝে আপনি হজের ঘোষণা করুন। তারা আপনার কাছে দূর-দূরান্ত থেকে কেউবা হেঁটে, কেউবা উঠের পিঠে সওয়ার হয়ে আসবে’ (সুরা আল হজ)। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর নির্দেশে হজ সম্পাদন করা ফরজ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন- ‘যে হজ মানুষকে গুনাহ এবং অন্যান্য খারাবি কাজ থেকে পবিত্র করে, তার পুরস্কার বেহেস্ত ছাড়া অন্য কিছুই নয়’। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মক্কা শরীফে গিয়ে হজ কর। পানি যেমন ময়লাকে ধৌত করে, হজ তেমনি পাপকে ধৌত করে। আল্লাহপাক বায়তুল্লাহকে এতই মর্যাদা দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তথায় একটি পয়সা দান করবে, সে লক্ষ পয়সার সওয়াব পাবে। আর যদি তথায় একটি রোযা রাখে তবে সে লক্ষ রোযার সওয়াব পাবে’। হজ সম্পাদনের মাধ্যমে প্রচুর সওয়াব অর্জন করা সম্ভব। প্রিয নবী রাসূল (সা.) বলেছেন, আরাফার দিন মহান আল্লাহ ফেরেস্তাদের ডেকে বলবেন, হে ফেরেস্তাগণ! তোমরা দেখ আমার বান্দাগণ বহু দূর দেশ থেকে কষ্ট করে এসে আরাফার ময়দানে ধুলা-মাটির সাথে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। শয়তান মালাউন নিজের হাত কপালে মেরে শত শত আফসোস করতে থাকবে’। এভাবে বিশ্বনবী (সা.) হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের উপর অনেক কথা বলেছেন। সারা বিশ্বের মোমিন মুসলমানগণ তা যথাযথভাবে পালন করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। হজ একটি আর্থিক ইবাদত। এ ইবাদত দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক এ তিন প্রকার শুকুর গোজারী আদায় হয়ে যায়।
হজ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- ইচ্ছা করা, সংকল্প করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় -‘নিদিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী নিধারিত সময়ে নিদিষ্ট স্থান সমূহের যিয়ারত ও প্রদক্ষিণ করাকে হজ বলে। এখন আমাদেরকে জানতে হবে, হজ কখন ফরজ হয়েছে? হজ কখন ফরজ হয়েছে তা নিয়ে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। একদল আলেম মনে করেন হজ মক্কায় হিজরতের পূর্বে ফরজ হয়েছে। তবে পরিবেশ প্রতিকূলতার কারণে হজ আদায় করা রাসূল (সা.) ও তার সাথীদের পক্ষে আদায় করা সম্ভব হয়নি। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ওয়াকেদীর মতে ৫ম হিজরী, আল্লামা রাফেয়ী বলেন, ৬ষ্ঠ হিজরী এবং কেউ কেউ বলেছেন ৭ম হিজরীতে হজ ফরজ হয়েছে। তবে ইমামূল হারামাইন ইবনুল জুযীর মতে, হজ নবম হিজরীতে ফরজ হয়েছে। তিনি দলিল হিসাবে কোরআনের আয়াত পেশ করেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘মানুষের মধ্যে থেকে যে কাবা শরীফ গমন করার সামর্থ্য রাখে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার ওপর হজ করা একান্ত কতৃব্য’। কোরআনের বানী সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এ আয়াতটি নবম হিজরিতে নাজিল হয়েছে। সে বছর রাসূল (সা.) হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক (রা)কে আমীরে হুজ্জাজ করে মক্কায় পাঠান এবং পরের বছর তথা ১০ম হিজরিতে বিশ্বনবী (সা.) হজ আদায় করেন।
কোরআন ও হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, শুধু সম্পদ থাকলেই মানুষের উপর হজ ফরজ হয় না। হজ ফরজ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যেমন- বুদ্ধিমান, স্বাধীন, সুস্থ্য, মুসলমান হওয়া, হজের সময় হওয়া, সম্পদশালী এবং যাতায়াতের পথ নিরাপদ হওয়া, বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া এবং মহিলাদের সাথে স্বামী অথবা মহরেম ব্যক্তি সাথে থাকা বাঞ্ছনীয়। হজ সম্পাদনকারী যখন হজ সম্পাদন করবেন তখন হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাবগুলো সুস্পষ্টভাবে পালন করতে হবে। আবার যেসব কার্যাবলী নিষিদ্ধ তা বর্জন করতে হবে। মোটকথা হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম হিসাবে মূল্যায়ন করার বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এভাবে সারা মুসলিম জাহান থেকে মোমিন মুসলমানগণ যখন কাবা শরীফে হজ আদায় করার জন্য আসে তখন হজ বা ওমরা আদায়ের জন্য ইহরাম বাঁধতে হবে। ইহরাম বাঁধার পর নীতিমালা অনুযায়ী সেলাইবিহীন তহবন্দ ও চাঁদর পরিধান করার বিধান রয়েছে। ইহরামের জন্য হজ অথবা ওমরার নিয়তে দুই রাকাত নামাজ শেষে তালবিয়াতের দোয়াটি-‘লাব্বায়িকা আল্লাহুমা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা, লাব্বায়িকা ইন্নাল হামদুওয়ান নিয়াতু লাকা ওয়াল মূলকা লা শারিকা লাকা’ পাঠ করতে হবে। মোটকথা ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। প্রত্যেক হাজী ব্যক্তিকে বাইতুল্লাহর সম্মানার্থে নিজ নিজ মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে। বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্য নিধারিত ৭টি মিকাত রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন পথে আসা হাজীদের জন্য মিকাত ভাগ করা রয়েছে। মিকাত সমূহ হলো যথাঃ যুল হুলায়ফা, যাতে ইরাক, জুহফা, কারণুল মানাযিল, ইয়ালামলাম, হিল্ল এবং হারাম।
মানব জীবনে হজ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইহা পালন করার জন্য ইহরাম বাঁধা, কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ ও আরাফার ময়দানে অবস্থান করতে হয়। হজ সম্পাদনের কারণে মহান আল্লাহ তাআলা বান্দার অতীত জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিজের জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফের জন্য রাজাধিরাজ মহান আল্লাহ দরবারে দোয়া করা হয়। দোয়ার অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! এই হলো আপনার এবং আপনার রাসূল (সা.)-এর হারাম শরীফ। অতএব আপনি আমার গোশত, আমার রক্ত এবং আমার চামড়া জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিন। হে আল্লাহ! যে দিন আপনি আপনার বান্দাগণকে আবার উঠাবেন, সে দিন আপনার শাস্তি থেকে আমাকে রক্ষা করুন’। হজ সম্পাদনকারী ব্যক্তি বিশ্বনবী (সা.)-এর স্মৃতিময় জীবনের অন্যতম স্থান সমূহ দর্শন লাভের সুযোগ পান। নবী (সা.)-এর স্মৃতিময় জীবনে হাজারে আসওয়াদ, কাবা শরীফ, মাকামে ইব্রাহীম, মুলতাজাম, মাতাফ, হাতিম, মিজাবে রহমত, জমজম, রুকনে ইয়ামেনি, রুকনে ইরাকী, রুকনে শামি এবং হেরা পর্ব্বত হাজীগণ স্ব-চোখে দেখার সৌভাগ্য জুটে। তখন প্রত্যেক হাজির হৃদয় জুড়ে মহা তৃপ্তির ঢেউ দোলে উঠে। দু’জাহানের বাদশাহ স্যাইয়েদুল মুরসালিন বিশ্বনবী (সা.)-এর শান্তিময় বাগ ইহ জগতের ঠিকানা পবিত্র রওজা মোবারক স্পর্শ এবং হযরত রাসূল (সা.)-এর অনু স্মরণ, অনুকরণকারী সাহাবীদের ঠিকানা জান্নাতুল বাকী যিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করা সম্ভব হয়। আমরা মানুষ। উঁচু-নীচুর পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু হজ সম্মেলনে উচু-নীচুর ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সাম্যের সেতুবন্ধন তৈরী করা সম্ভব হয়। তাছাড়া এ ইবাদত পালনের সময় প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয় মাঝে প্রচ- তাকওয়া খোদাভীতি অর্জন হয়। যা অন্য কোন সময়ে এমন খোদাভীতি অর্জন করা সম্ভব হয় না।
লেখক: গ্রন্থকার ও সাংবাদিক, প্রভাষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন