নির্বিচারে বন উজাড় করে, সমুদ্র থেকে মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণ করে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট করছে মানুষ। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণীর জীবন আজ হুমকির মুখে। বন ধ্বংসের ফলে আমাদের জাতীয় পশু সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারও এখন বিপন্ন প্রায়। দেশের ৩৯০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯টি গত ১০০ বছরের বেশি সময়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। প্রাণীর অধিকার রক্ষা ও কল্যাণার্থে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। প্রাণী হিসেবে তাদের যে বেঁচে থাকার অধিকার সে অধিকার নিশ্চিতে জনসচেতনতার উদ্দেশে ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে ৪ অক্টোবর বিশ্ব প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ন্যাচার ওয়াচ ফাউন্ডেশন দিবসটি সারা বিশ্বে পালন করে থাকে। এ ছাড়াও দেশে দেশে প্রাণী কল্যাণমূলক সংস্থা দিবসটি পালন করে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮/ক অনুচ্ছেদে, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা আছে। তাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও তাদের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বন ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। বন রক্ষার সঙ্গে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের মাধ্যমে অবাধে কার্বন নিঃসরণের ফলে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই হয়নি, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হাতি, বাঘসহ অনেক প্রজাতির প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ছে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম বনভূমি পরিবেষ্টিত দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশে বনভ‚মির হার মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আইন প্রয়োগে ঘাটতির কারণে নির্বিচারে বন নিধনের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভাওয়ালের শালবন। এরই মধ্যে বনটির প্রায় ৯০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সক্ষম পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন নির্বিচারে গাছ নিধন, উজান থেকে মিষ্টি পানিপ্রবাহে ঘাটতির কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এরই মধ্যে হুমকির সম্মুখীন। লবণাক্ততার ফলে সুন্দরী গাছের আগা মরে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে।
জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল সম্ভার সুন্দরবন ৪৫৩টি প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল, যেগুলো আজ বিপন্নপ্রায়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা এক সময় ৪০০-৪৫০টি থাকলেও অপ্রতিরোধ্য চোরাইভাবে পাচারের ফলে বর্তমানে তা ১০০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে। উপরন্তু পরিবেশ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৫-এর অধীনে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট ও এর চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্ররিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা বা বাফার জোন ঘোষণা করা হলেও এর ভেতর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে। এতে সুন্দরবনে বসবাসরত বন্যপ্রাণীর জীবনও হুমকির মধ্যে পড়বে।
বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান রেড লিস্ট প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, দেশের ৩৯০ প্রজাতির বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯টি গত ১০০ বছরের বেশি সময়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির দৌড়ে দ্বিতীয় অবস্থান স্তন্যপায়ী প্রাণীদের। ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়ে গেছে এই সময়ে। আর সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে একটি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউড্লিউএফ) নামে জীববৈচিত্র্য রক্ষার সঙ্গে জড়িত একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ৫০ বছর সময়ের মধ্যে বিশ্বে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
এদিকে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা কয়েক হাজার প্রজাতির বন্যপ্রানীর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন স্তন্যপায়ী, খেচর, উভচর, সরীসৃপ এবং মৎস্যকুলের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার প্রজাতি ১৯৭০ সালের পর ৫০ বছর সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়াও, ২০০০ সালের পর থেকে ১.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বন্যপ্রাণীর আবাসভ‚মি বিলুপ্ত হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক মিলিয়ন প্রজাতি। ডব্লিউডব্লিউএফ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মানুষ বিভিন্নভাবে জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি করেছে তা এর আগে অন্য কেউ করতে পারেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন