শফিউল আলম : জাহাজের নেই গতি। হলো না পরিবেশের কোন গতি। সেই জাহাজের নাম ‘বে ক্লিনার-২’। এখন চট্টগ্রাম বন্দরের গলার কাঁটা। অকেজো ভাসছে বন্দরে। অলস বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে জাহাজের নাবিক-কর্মচারীদের। ‘বে ক্লিনার-২’ নামের জাহাজটি অত্যন্ত নিম্নমানের, পুরনো যন্ত্রপাতি জোড়াতালি দিয়ে নির্মিত হয়। জাহাজ নির্মাতা স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও ঘাপলার খেসারত দিতে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। বন্দর, বহির্নোঙর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় জ্বালানি তেল বা তেলের বর্জ্য, গাদ, পোড়া তেল প্রভৃতি অপসারণ করে নিয়ে ‘পরিবেশ রক্ষা’র জরুরি প্রয়োজনে কবে নাগাদ ‘বে ক্লিনার-২’ সচল হতে পারবে তা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তারাও।
আইএসপিএস (আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বন্দর নিরাপত্তা) ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি-বিধানের শর্তাবলী পরিপূরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরেও। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষায়িত একাধিক জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। তেল বা তেলবর্জ্য, গাদ, পোড়া তেলে যে কোন ধরনের দূষণরোধে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয়সহ ‘রক্ষণাবেক্ষণ’ ব্যয়ের বিশেষায়িত সেই জাহাজ ‘বে ক্লিনার-২’ গত সাড়ে ৪ বছর যাবৎ অকেজো অবস্থায় বন্দরের জেটিতে অলস ভাসছে। অন্যদিকে বন্দরের পতেঙ্গা অয়েল জেটি-বার্থসমূহ ও বিভিন্ন স্পর্শকাতর পয়েন্টে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তেল ও বর্জ্যতেল ভাসতে।
আর অলস জাহাজটির কথিত মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, নাবিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি মিলিয়ে কোটি কোটি টাকা প্রতিনিয়ত অপচয় হয়ে আসছে। বিশেষায়িত জাহাজ সম্পূর্ণ অলস বসে থাকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে বন্দর-শিপিং সার্কেলে। ‘অত্যাধুনিক’ বলে কিভাবে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরকে গছিয়ে দেয়া হয়েছিলো এবং এর পেছনে দুর্নীতিবাজ চক্রের ভাগবাটোয়ারা নিয়েও এখন সঙ্গতভাবে প্রশ্ন উঠেছে। ‘বে ক্লিনার-২’ তৈরির পর থেকে এখনও কোন অপারেশনে যেতে সমর্থ হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংগ্রহ করা হয় ‘বে-ক্লিনার-১’ ও ‘বে-ক্লিনার-২’। উভয় জাহাজ সাগর কিংবা উপকূলভাগে ভাসমান বর্জ্য তেল অপসারণের কাজের জন্যই নির্মিত হয়েছে। এ যাবত কাজ-কর্মহীন অলস বসে থাকায় জাহাজ দু’টির পেছনে পরিচালন খরচ হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা।
বন্দর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় তেলবর্জ্য দূষণরোধে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে বাধ্যবাধকতা থাকার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ একটি প্রকল্প-পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় বন্দর এলাকার কোথাও ছড়িয়ে পড়া তেল নদীর পানি থেকে শুষে নেয়া এবং ভাসমান তেলবর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য কেনা হয় দু’টি জাহাজ ‘বে-ক্লিনার-১’ ও ‘বে-ক্লিনার-২’। বে-ক্লিনার-১-এর কাজ হচ্ছে বন্দরের বহির্নোঙরে পানিতে ভাসমান বস্তু তুলে নিয়ে তা নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশনে জমা করা।
বে-ক্লিনার-২-এর কাজ হলো নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়া বা জাহাজের ভেতর থেকে পড়ে যাওয়া তেল সংগ্রহ করে নিয়ে দূষণ রোধ করা। জাহাজে থাকা এক ধরনের ফোম দিয়ে বে-ক্লিনার-২ নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়া রোধ করে নির্ধারিত স্থান থেকে তেল জমা করতে সক্ষম। একসঙ্গে ৭০ হাজার লিটার তেল, তেলজাতীয় বর্জ্য বা পানি শুষে নেয়ার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে জাহাজটির। আইএসপিএস বিধিমালা এবং ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) নীতিমালা অনুযায়ী পৃথিবীর প্রত্যেক বন্দরেই এ ধরনের দূষণরোধক বিশেষায়িত জাহাজ থাকার বিধান রয়েছে। অথচ বর্তমানে জাহাজ দু’টি অচল থাকার কারণে বন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় তেল দূষণ রোধে কোন ভূমিকা পালন করা সম্ভব হচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন