স্টাফ রিপোর্টার : ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহর কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শফিউল্লাহ পঁচাত্তরের সেই রাতে কিছু সংখ্যক সেনা সদস্যকে ট্যাঙ্ক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে যাওয়ার খবর পেয়ে নিশ্চুপ ছিলেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে কেউ ভালো থাকতে পারেনি। ওই জিয়াউর রহমানেরও ভালো যায়নি, খালেদ মোশাররফেরও ভালো যায়নি। আর শফিউল্লাহ তো জীবন্ত মৃত। উনাকে সবাই ঘৃণা করে। কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক। উনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে মতিঝিলে এফবিসিসিআইয়ের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
শেখ সেলিম বলেন, ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য কলঙ্কময় একটি দিন। জীবনের সব সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন, দুই-দুইবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু সেই পদকে পদদলিত করে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের জন্য ফাঁসির মঞ্চকেও বেছে নিয়েছিলেন। বাঙালিকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাকে হত্যা করে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে।
১৫ আগস্ট রাতের ঘটনা বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাগ্নে ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, কয়েকজন আর্মি আমাদের বাড়িতে ঢুকে মনি ভাই কোথায়, মনি ভাই কোথায়, বলছিল। মনি ভাই বলেন, আমি মনি। কী হইসে? ওরা বলে ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। কী অপরাধ করেছি আমিÑপ্রশ্ন করেন মনি ভাই। সঙ্গে সঙ্গে তার চুল ধরে ফেলে ওরা। আমি শব্দ শুনে সেখানে গেলাম। ওরা বলল, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। মনি ভাই বলেন, ঠিক আছে। এরপর একটু পেছনে ঘোরার চেষ্টা করতেই ওরা ব্রাশফায়ার করল। ভাবিকেও গুলি করল। আমিও পড়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিং ছিল যে গুলি করলে শুয়ে পড়তে হবে। মা সবাইকে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে এসে চিৎকার শুরু করল। এরপর বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলাম। কেউ ধরে না। পরে জামাল ফোন ধরল। আমার ভাই জামালকে বলল, মনি ভাইকে মেরে ফেলেছে। ওই পাশ থেকে বঙ্গবন্ধুর গলা এলো যে, ‘আমার মনিকে মেরে ফেলছে?’ ভাবি পড়ে ছিলেন। বললেন আমাকে বাঁচান। আমার বাচ্চা আছে। এরপর গাড়ি করে আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা শেখ মনি ও তার স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে সেলিম বলেন, হাসপাতাল থেকে নিচে নেমে আসার পর জানলাম, বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন।
শেখ সেলিম বলেন, বাড়িতে অ্যাটাক হওয়ার পর কিন্তু বঙ্গবন্ধু কয়েক জায়গায় ফোন করেছেন এবং আর্মি চিফ শফিউল্লাহকে ফোন করেছেন। এইখানে আরেকটা ঘটনা আছে অনেকেই জানে না। ট্যাঙ্ক যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে ৪টা। কর্নেল সালাউদ্দিন নামের এক অফিসার (চট্টগ্রাম বাড়ি) ট্যাঙ্ক বের হওয়ার সময় আর্মি চিফের কাছে ছুটে যায়। আর জানায়, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে। শফিউল্লাহকে বলে, স্যার, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে, বোধহয় প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে যাচ্ছে। স্যার আপনাকে এটা ইনফর্ম করতে এলাম।
শেখ সেলিম বলেন, আমাদের বাড়িতে গেছে ৫টায়, বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন সাড়ে ৫টায়। সাড়ে ৪টায় যখন খবর পেল আর্মি চিফ... শফিউল্লাহ তখন কী করছিল? আরে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বানাইসে, আর্মি চিফ বানাইসে। আরে কোথায় থাকতি? পাকিস্তানের গোলাম হিসেবে থাকতি।
তিনি বলেন, সেই সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা সময়টায় শফিউল্লাহ কী করেছে? গাড়ি নিয়ে তখন ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে যাবে না? ডেপুটি চিফের কাছে যাবে না? ধরে নিলাম জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত। তখন সিজিএস খালেদ মোশাররফের কাছে যাবে না? দশটা ট্রাক যদি রওনা দিত ওরা পালাবারও জায়গা পেত না।
সেলিম আরও বলেন, এছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজে ওই রাতে শফিউল্লাহকে ফোন করে বলেছিলেন, তোমার আর্মি আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। শফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি দেখছি’। দ্বিতীয়বার যখন বঙ্গবন্ধু ফোন করে শফিউল্লাহ বলে, ‘স্যার, আপনি একটু বাসা থেকে সরে যেতে পারেন না?’ তখন বঙ্গবন্ধু রাগ করে ফোন রেখে দেন।
তিনি বলেন, তাহলে কি আমরা মনে করতে পারি না, এই আর্মি চিফ শফিউল্লাহ বলেন, খালেদ মোশাররফ বলেন, জিয়াউর রহমান বলেনÑতারা এই ঘটনায় বিন্দুমাত্র রিঅ্যাক্ট করেনি। তার মানে কি তারা জানত বিষয়টা? ওই সময় যদি তারা মুভ করত তাহলে বঙ্গবন্ধু কি মারা যান? এইটা কি কেউ চিন্তা করে দেখেছেন?
আওয়ামী লীগের সিনিয়র এ নেতা বলেন, যারা ওই ঘটনা ঘটালো, সেনা অর্ডারের বাইরে যারা গেল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না? কেন ব্যবস্থা নিল না। মেজর ডালিম, রশীদ কীভাবে এরপর ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল? সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য এখনও বের হয়নি।
আলোচনা সভায় দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান ও সাবেক নেতারা। এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের কারণে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। ওই সময়ে তিনি দেশের উন্নয়নের ছক করেছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই উন্নয়নের ছকে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর একটা স্ট্রং ইকোনমি গড়ার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আসুন, ব্যবসায়ী বন্ধুরা প্রধানমন্ত্রীর হাতে হাত ধরি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান বলেন, আজকে দেশ স্বাধীন না হলে কোনো কিছুই অর্জন হতো না। বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর অবদান জানতে হবে সবাইকে। অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সেটা ধরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষ যেন সুখী থাকে, ভালো থাকে। এটা নিশ্চিতে সবাইকে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন। ব্যবসায়ীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। সেটি আরও ভালোভাবে পালন করতে হবে। এই সরকার ব্যবসায়ীবান্ধব। প্রধানমন্ত্রী অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবেন।
সভায় অন্যদের মধ্যে সংগঠনের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, মীর নাসির উদ্দিন ও একে আজাদ বক্তব্য দেন। অন্যদের মধ্যে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন