এ.জেড.এম শামসুল আলম : মরহুম হযরত মাওলানা আবদুল মান্নানের (রা.) জীবনের সর্ব প্রধান পেশা ও নেশা ছিল আলিয়া নিসাবের মাদ্রাসার সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। মাওলানা আবদুল মান্নানের ন্যায় নিবেদিত প্রাণ সেবকের আবির্ভাব না হলে বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসাসমূহ যে স্তরে পৌঁছেছে, ঐ উন্নীত স্তরে হয়তো থাকত না। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সর্বশক্তিমান। তিনি আলিয়া মাদ্রাসার বহুমুখী উন্নয়নে মাওলানা আবদুল মান্নানের মেধা, শ্রম ও অবদান কবুল করে নিবেন ইনশাআল্লাহ।
১৯৩৭ সন থেকে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত প্রত্যেক মাদ্রাসা শিক্ষকের জন্য সরকারি অনুদান বা ভাতা ছিল মাথাপিছু মাসিক তিন টাকা। আলিম এবং কওমী লাইনের পঞ্চম ক্লাস স্তরের শিক্ষকগণ এ ভাতা পেতেন। বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকগণও ভাতা পেতেন মাসিক তিন টাকা। সরকারি অনুদান হিসেবে প্রতি কলেজ শিক্ষক পেতেন মাথা পিছু ভাতা মাসিক পাঁচ টাকা।
১৯৪৮ সন থেকে ১৯৫৬ সন পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষকের ভাতা ছিল মাথাপিছু মাসিক পাঁচ টাকা। যারা শিক্ষক নন ঐরূপ কর্মচারীদের মাসিক ভাতা ছিল মাথাপিছু, ঐ সময়ে মাসিক তিন টাকা। ১৯৫৭ সনে এম এ মাওলানা মান্নান এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকের ভাতা বা অনুদান করা হয় মাসিক দশ টাকা। শিক্ষক নন এরূপ কর্মকর্তাদের জন্য অনুদান তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়।
১৯৬২ সনে হযরত মাওলানা এম এ মান্নান ইস্ট পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি খুব সম্ভব ১৯৬৭ সন পর্যন্ত আইনসভার সদস্য ছিলেন। জুলাই ১৯৬২ থেকে মার্চ ১৯৬৫ পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নান ইস্ট পাকিস্তান এসেম্বলির পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন।
মাওলানা আবদুল মান্নান শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষকদেরই প্রতিনিধিত্ব করতেনÑ তা নয়। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকের স্বার্থের প্রতিও তিনি উদাসীন ছিলেন না। সর্বস্তরে তিনি তাদেরও প্রতিনিধিত্ব করতেন। এ সময় বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী মাওলানা আবদুল মান্নানের ন্যায় প্রতিভাধর প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে দেখা যায়নি। তাই স্কুল কলেজ শিক্ষকগণও মাওলানা আবদুল মান্নানের পেছনে কাতার বন্দি হন।
১৯৬২ সনে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান বৃদ্ধির যোক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। তার এ ভাষণ এবং আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাস শিক্ষকদের জন্য মাসিক অনুদান দশ টাকা থেকে বিশ টাকায় উন্নীত হয়।
বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের পদবী ছিল এসিস্টেন্ট টিচার বা সহকারী শিক্ষক। শুধু ক্ষুদ্র কলেজের শিক্ষক নন, জগন্নাথ কলেজের ন্যায় বৃহৎ বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকের মাসিক সরকারি অনুদান হয়েছিল বিশ টাকা। শিক্ষক নয় এমন কর্মচারীদের জন্য সরকারি অনুদান ছিল সে সময় মাথা পিছু দশ টাকা।
তখন মাওলানা এম এ মান্নান ছিলেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা শিক্ষক ফেডারেশেনের কনভেনর।
১৯৭০ সনে রিয়াল অ্যাডমিরাল এসএম আহসান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি ইতোপূর্বে ছিলেন ঊচওডঞঅ-এর চেয়ারম্যান। তখন থেকেই মাওলানা এম এ মান্নানের সাথে এসএম আহসানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তারই সময় এবং মাওলানা মান্নানের প্রচেষ্টায় শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদানের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়।
শিক্ষকদের জন্য সর্বনি¤œ অনুদান মাসিক বিশ টাকা থেকে পঁয়ত্রিশ টাকাতে বৃদ্ধি করা হয়। কামিল এবং এমএ পাস শিক্ষকদের মাসিক ভাতা করা হয় ৬৫ টাকা। ৩৫ টাকা এবং ৬৫ টাকার অন্তর্বর্র্তী শিক্ষকদের আরো দুটি গ্রেড ছিল মাসিক ৪৫ এবং ৫৫ টাকা।
১৯৭৭ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে সকল শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান ১০০/- টাকা করা হয়।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান ছিলেন বাংলাদেশ “ফেডারেশন অব টিচারস অ্যাসোসিয়েশন অব নন গভার্নমেন্ট স্কুল, কলেজ অ্যান্ড মাদ্রাসা”-এর আহ্বায়ক (১৯৭৮)।
১৯৭৮ সনে সকল বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান করা হয় ২০০/- টাকা।
১৯৭৯ সনে অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে স্বাক্ষর করেন মাওলানা আবদুল মান্নান।
এ চুক্তি অনুসারে শিক্ষকদের সমস্যা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন কাজী আনোয়ারুল হক সিএসপি এবং সচিব ছিলেন শিক্ষা সচিব মুজিবুল হক সিএসপি। পরবর্তীতে কাজী ফজলুর রহমান সিএসপি।
কাজী আনোয়ারুল হকের পর এ কমিটির সভাপতি হন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কুষ্টিয়ার শাহ আজিজুর রহমান। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুল বাতেন এ কমিটির সদস্য ছিলেন। এ কমিটির সুপরিশ্রক্রমে কলেজ শিক্ষকদের চারটি স্তরে শ্রেণীবিন্যাস করা হয় যেমনÑ (১) খবপঃঁৎবৎ প্রভাষক (২) অংংরংঃধহঃ চৎড়ভবংংড়ৎ সহকারী অধ্যাপক (৩) অংংড়পরধঃব চৎড়ভবংংড়ৎ সহযোগী অধ্যাপক, (৪) চৎড়ভবংংড়ৎ অধ্যাপক। এ কমিটির সুপারিশক্রমে শিক্ষকদের চাকরি বিধিপ্রণীত হয়। চাকরি বিধির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল “দোষী শিক্ষকদের বরখাস্তকরণের এবং শাস্তির বিধিমালা প্রণয়ন”।
রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান শিক্ষকদের জন্য চাকরি বিধি প্রণয়ন এবং তাদের প্রাপ্য সম্পর্কে খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ওয়াদার ভিত্তিতে ১৯৮১ সনের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর শিক্ষকগণ এক সঙ্গে সতের মাসের শিক্ষক অনুদান পান। এজন্য সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয় তৎকালীন ৫৯ কোটি টাকা। শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন এ সময় শিক্ষামন্ত্রী। এ বাদী পূরণে মাওলানা এম এ মান্নানের অবদান ছিল অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিক্ষকগণ জাতীয় সমস্যাসমূহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮২ সনের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। মাওলানা এম এ মান্নান নির্বাচিত হন সেক্রেটারি জেনারেল। এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষকগণ সরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের মূল বেতন এর ৫০% অনুদান হিসেবে পাবেন। যদিও এ সিদ্ধান্ত গৃহীত ১৯৮২ সনে, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৯ সন থেকে। এ সময় শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পদবী ইত্যাদি সরকারিভাবে নিরীক্ষা করা হয়নি। ১৯৮৩ সনে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অনুদান সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল বেতনের ৬০% (জবারংবফ ঝপধষব) উন্নীত করা হয়। ১৯৮৪ সনে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য বাড়িভাড়া নির্ধারিত হয় মাসিক ২০০/- এবং চিকিৎসা ভাতা নির্ধারিত হয় মাসিক ২০০/- টাকা। এ অনুদান শিক্ষক ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।
মাওলানাা এম এ মান্নানের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৮৬ সনে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অনুদান সরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের ৭০%-এ উন্নীত হয়। ১৯৮৬ সনের জুন মাস থেকে ১৯৮৮ সনের জুন মাস পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নন বাংলাদেশ সরকারের ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৭ সনের মহাবন্যায় সময় তাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা উন্নয়ন ও শিক্ষকদের কল্যাণে মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান উপমহাদেশে অতুলনীয়। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষক ব্যবস্থা ব্রিটিশদের উপমহাদেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ বিলীন না হলেও আধামরা হয়ে ছিল। নিজস্ব পরিম-লে মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মাসিক মদিনা সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান প্রমুখ খ্যাতমানা মহান ব্যক্তিবর্গ অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু সামগ্রিক আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নানকে মাদ্রাসা শিক্ষায় তার চির স্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে পরকালে যথাযথ জাজায়ে খায়ের নসিব করুন।
লেখক : সাবেক সচিব, সাবেক মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন