শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর ইন্তেকাল বার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা

শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম | আপডেট : ১২:২৫ এএম, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের রূপকার ভূতপূর্ব শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, ধর্ম ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ইসলামী চিন্তাবিদ, বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও অভিভাবক আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মানুষ গড়ার দক্ষ কারিগর। শিক্ষক সংগঠক হিসেবে ছিলেন দিক-দিশারী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনে তিনি স্মরণীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া আলিয়া মাদরাসাকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করেছেন। ইসলামপুরে (চাঁদপুর) ফাজিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন বহু প্রতিষ্ঠানের অবিভাবক। ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাৎ আলিয়া মাদরাসাসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবিরাম চেষ্টা ও সাধনা এবং শিক্ষা ও শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর অসামান্য অবদান কোনো দিন ভুলবার নয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু মূল্যবান অবদান ছিল মাওলানা এম এ মান্নানের। তবে মূল চিন্তা-চেতনা ছিল শিক্ষাকেন্দ্রিক। শিক্ষার মান উন্নীত করা, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য পুস্তকসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা, শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা, তাঁদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করা, তাদের একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাঙ্গনে শান্তি শৃঙ্খলা ও জ্ঞান-গবেষণার অনুকূল শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি নিয়ে সর্বদা তিনি ভাবতেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ গবেষকদের সাথে এ নিয়ে যোগাযোগ করতেন, মতবিনিময় করতেন, দেশে ও বিদেশে অনুষ্ঠিত বহু শিক্ষা সম্মেলন, মহাসম্মেলন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, মতবিনিময় সভায় যোগদান করেছেন তিনি। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. আবদুল্লাহ ওমর নাসীব, জামেউল আজহার আল শরীফের প্রধান শেখুল আজহার জাদুল হক জাদসহ ত্রিপলি (লিবিয়া), দামেস্ক (সিরিয়া), বাগদাদ (ইরাক), ইসলামাবাদ (পাকিস্তান), দিল্লি (ভারত)সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষকদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। এসব যোগাযোগ ও কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে নিজের জ্ঞান-অভিজ্ঞতাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন এবং তার আলোকে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি তৈরি করেছেন। যদিও তিনি ছিলেন আলীয়াধারার মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন প্রখ্যাত, আলেমে দ্বীন এবং আলিয়া নেসাবের শিক্ষাধারাকে কেন্দ্র করেই ছিল তাঁর মূল কর্মকান্ড, তবু তিনি দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাধারা ও শিক্ষাক্রমের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছেন। দেশের বিখ্যাত কওমী মাদরাসাসমূহের বিভিন্ন সমাবেশে যোগদান করেছেন, মতবিনিময় করেছেন, তাদের সমস্যা সমাধানে অবদান রেখেছেন, উন্নয়নে সহায়তা দানের চেষ্টা করেছেন। ফোরকানিয়া মাদরাসায় কারী-হাফেজদের সাথে টোলের-পন্তডিদের একত্রে বসিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক ও মাদারাসার মোদার্রেছদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে বৈঠকের পর বৈঠক করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্যাবলি চি‎িহ্নত করেছেন, তার থেকে উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন করেছেন। সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন।
যদিও তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন তবুও শিক্ষা সংক্রান্ত সভা-সমাবেশ, সংগঠন, আন্দোলনকে রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে দেননি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সর্বদা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখেছেন। বিষয়টি আর একটু খোলাসা করে বলছি।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আত্মপ্রকাশ ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩০-এর দশকে। তবে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে আজকের মতো সাংগঠনিকভাবে তা এমন সুগঠিত, মজবুত, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত ছিল না। বাংলাদেশ আমলে এসেই আজকের রূপ লাভ করে। এ ক্ষেত্রে মাওলানা এম এ মান্নানের অবদান অপরিসীম। পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি এর সাথে সম্পৃৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ আমলে এসে ১৯৭৬ সালে এর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এর পুনর্গঠনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। দেশের সর্বত্র সভা-সমাবেশ করে শিক্ষক ও কর্মচারীদের এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাদের প্রাণে সৃষ্টি করেন প্রেরণার জোয়ার। তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কর্মসূচি দিতে থাকেন একের পর এক। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সকল এলাকার শিক্ষক-কর্মচারীগণ যোগদান করতে থাকেন রাজধানীতে আহূত বিভিন্ন সম্মেলন- মহাসম্মেলনে। সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় তুলে ধরতে থাকেন তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া। কর্তৃপক্ষের সাথে করতে থাকেন বৈঠকের পর বৈঠক। তাঁর জাদুকরী ভাষণ ও ক্ষুরধার যুক্তিতে কর্তৃপক্ষও এগিয়ে আসে। তখন কাগজে-কলমে মাদরাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর প্রাইমারির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তেমনি ছিল না সাধারণ শিক্ষার সাথে সমমান। ছিল না মাদরাসা শিক্ষাধারায় স্নাকত্তোর পর্যায়ের স্বীকৃত ও সনদ প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ইবতেদায়ী স্তর বাস্তব রূপ লাভ করে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা গড়ে ওঠে প্রায় একুশ হাজার। সরকার মেনে নেয় ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের তথা স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও মাদরাসা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্যের অজুহাত দেখিয়ে তা বাস্তবায়নে যখন টালবাহানা পরিলক্ষিত হয় তখন তা নিরসন করে সবার দাবি সমন্বিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সকল বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনকে একই ছাতার তলে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেন। এ জন্য বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকের পর বৈঠক করে সবাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। যোগ করেন আন্দোলনের নতুন মাত্রা। দাবি তোলেন বেতন স্কেল প্রবর্তনের, এরপর দাবি উত্থাপন করেন সে বেতন স্কেলে সরকারি অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধির। ক্রমান্বয়ে তা ১০০% উন্নীতকরণ, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া ভাতা, বিভিন্ন উৎসব বোনাসসহ সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ সর্বক্ষেত্রে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি উত্থাপন করেন। দিনে দিনে একের পর এক তা পূর্ণ হতে হতে আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে একদা যেখানে একজন শিক্ষক সরকারি অনুদান পেতেন মাত্র পাঁচ টাকা। আজকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তা ৫০ হাজারে উপনীত হয়েছে। ক্রমান্বয়ে প্রবর্তিত ও বর্ধিত হয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও। এ ব্যাপারে যে মহান নেতার চিন্তা, পরিকল্পনা, কর্মসূচি, আন্দোলন নেতৃত্ব দিবালোকের মতো ভাস্বর তিনি আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান। কোন সময়ে কোন পন্থায় লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে তিনি তা অত্যন্ত ভালোভাবে জানতেন। তিনি মানুষ চিনতেন, কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে তা জানতেন এবং কাজেও লাগাতে পারতেন। তাঁর কর্মকৌশল ছিল বিস্ময়কর।
একদা বেসরকারি শিক্ষক সমাজ, বিশেষ করে মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীগণ ছিলেন অবহেলিত-বঞ্চিত, অধিকারীহারা ও দুর্দশাগ্রস্ত, তাদের তিনি যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আশার বাণী শুনিয়েছিলেন তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সমস্যার সমাধান, শিক্ষার সম্প্রসারণ, শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিতকরণ, শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম। তাঁর একটা বড় স্বপ্ন ছিল ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। তা আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে। তিনি কেবল স্বপ্ন-দ্রষ্টাই নন, স্বপ্নের বাস্তব রূপকার। অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্যও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
তোফাজ্জল হোসেন ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব মাদরাসা শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নে আজীবন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন নিরহংকার ব্যক্তিত্ব ও নেতা।
Total Reply(0)
জাহিদ খান ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:০২ এএম says : 0
মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবের সারাজীবনের ত্যাগ ও কর্ম পরিসর আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। মরহুমের বিশেষ অবদানের মধ্যে রয়েছে শত শত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, লাখ লাখ মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এবং ইসলামী অঙ্গনের জন্য প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইনকিলাব।
Total Reply(0)
কে এম শাকীর ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:০৩ এএম says : 0
মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবকে আল্লাহতায়ালা উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা, মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা দিয়ে ছিলেন। মাদরাসা শিক্ষকসহ সমগ্র শিক্ষক সমাজের হৃদয়ের স্পন্দন ছিলেন তিনি। মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব দেশে ও ইসলামী বিশ্বের সকল রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি সকল প্রতিকূলতা দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করেছেন। প্রকৃত অর্থে মরহুম মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবের তুলনা তিনি নিজেই।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন