শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর ইন্তেকাল বার্ষিকী বিশেষ সংখ্যা

ক্রান্তিকালের অগ্রসেনানী

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৫ এএম

তোতা, তোমার এলাকার খবর কী? এক এক করে বলো, শুনি’- ১৯৯০ সালের দিকে এভাবেই মাঝেমধ্যে ল্যান্ডফোনে অনেক সময় ধরে কথা বলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পত্রিকা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলার বিস্তারিত খবরাদি নিতেন দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। পত্রিকা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাও দিতেন টাইম টু টাইম। শুধু আমাকে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইনকিলাব ব্যুরো অফিসে প্রায়ই টেলিফোন করতেন। সবকিছু থাকতো তার নখদর্পণে। তিনি মাঝেমধ্যে মিটিং করে বলতেন, তার ইচ্ছা ও স্বপ্নের কথা। কখনোই তাঁর মুখ থেকে ব্যক্তিগত সখ, আহ্লাদ ও স্বপ্ন বাসনার কথা শুনিনি। সবসময়ই দেশ ও দশের কথা মাথায় থাকতো তাঁর। দৈনিক ইনকিলাব ছিল তাঁর স্বপ্নের বাহন। মানুষ হিসেবে সমাজে চলার পথে কী কী অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতেন। অত্যন্ত সদালাপী মানুষটির কাছে অসম্ভব বলে কোনো বাক্য ছিল না। আশাবাদী মানুষটির মুখে থাকতো ইনশাআল্লাহ হবেই। মাঠের খবর নেওয়ার প্রচন্ড আগ্রহ দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। আমরা অভিভূত ও উজ্জীবিত হতাম তাঁর দৃঢ়তায়।

মাঠ সাংবাদিকতা বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে দেশ ও জনগণের মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাবের ভূমিকা অন্যতম। মাওলানা মান্নান রহ.-এর নির্দেশে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী ইনকিলাবের সম্পাদক আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন সর্বপ্রথম ঢাকার বাইরে মফস্বলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যুরো ও অঞ্চলিক অফিস স্থাপন করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বলা যায়, ইনকিলাব এক্ষেত্রে মডেল। একযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১২টি ব্যুরো ও অঞ্চলিক অফিস স্থাপনের নজির অন্য কারো নেই। তাঁর চিন্তা চেতনা ও দুরদর্শিতায় ইনকিলাবকে নিতে পেরেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। ইনকিলাব পরিবারের প্রতিটি সদস্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁর কথা স্মরণ করেন। সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি পুরোপুরি একজন সফল মানুষ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

১৯৯১ সালের প্রথমদিকের স্মৃতি। খুলনায় মাদরাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বিভাগীয় সমাবেশের প্রধান অতিথি হুজুর। ঢাকা থেকে বিমানে যশোর এবং যশোর থেকে সড়কপথে খুলনায় গিয়েছিলেন। যশোরের জমিয়ত নেতা মাওলানা নূরুল ইসলাম এবং আমিসহ ঢাকা ও যশোরের কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক তাঁর সফরসঙ্গী ছিলাম। সমাবেশের আগমুহূর্তে দুপুরের খাবার দেয়া হচ্ছে। আয়োজকরা হুজুর ও বিশেষ অতিথি কবি মাওলানা রুহুল আমীন খানসহ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সার্কিট হাউসে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। হুজুর খাবারের রুমে সাংবাদিকদের না দেখে আয়োজকদের বললেন, সাংবাদিকদের আগে বসার ব্যবস্থা করেন। আমাদের ডেকে বসানোর পর আয়োজকদের বলেন, এই যে শোনেন, সবসময় সাংবাদিকদের মর্যাদা-সম্মান দেওয়ার বিষয়টি লক্ষ রাখবেন, মূল্যায়ন করবেন। তারা খুব কষ্ট করেন। আমাদের বক্তৃতার শব্দকথার মালা গাঁথেন।

মাওলানা এম এ মান্নান রহ.-এর যে মেধা, প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। আজ তাঁর ইন্তেকালবার্ষিকী উপলক্ষে লেখাটি লিখতে গিয়ে বারবারই হোঁচট খেয়েছি। এটা বাদ গেল, ওটা বাদ গেল- মাথার ভেতরে শুধু এভাবেই খেলা করলো অনেকক্ষণ। নব্বই-এর দশকে অনেক স্মৃতি আছে হুজুরের সাথে। ব্রিটিশ আমলে মাওলানা আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ এবং স্বাধীনতার পরে মাওলানা এম এ মান্নান রহ. দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনি চেতনাসম্পন্নদের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার বিমূর্ত প্রতীক ও উজ্জ্বল জ্যোতি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন। ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকালে ইনকিলাব প্রকাশ করে অগ্রসেনানীর ভূমিকা পালন করেন মাওলানা এম এ মান্নান রহ.। ব্যক্তিগতভাবে আমার সৌভাগ্য হয়েছে দৈনিক আজাদ ও দৈনিক ইনকিলাবে সাংবাদিকতা করার। টানা ৪২ বছরের সাংবাদিকতায় স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক স্ফুলিঙ্গে বার্তা সম্পাদক ও দৈনিক ঠিকানায় নির্বাহী সম্পাদক এবং দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক আজাদ ও সর্বশেষ একটানা দৈনিক ইনকিলাবে স্টাফ রিপোর্টার, ব্যুরো চিফ ও বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইনকিলাবেই সাংবাদিকতার দীর্ঘসময় কেটে গেল। ব্যক্তিগতভাবে অনেক ঋণী ইনকিলাবের কাছে। গবেষণাগ্রন্থ মাঠ সাংবাদিকতা, আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ক্ষতবিক্ষত বিবেক এবং কাব্যগ্রন্থ দিবানিশি স্বপ্নের খেলা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে যুক্তথাকালেই। এটি আমার পরম পাওয়া।

যাইহোক, স্মৃতিচারণে এসব রিলেটেড বিষয় এসেই যায়। বলতে দ্বিধা নেই যে, জীবন সংগ্রাম ও সাধনা চেতনার নাম মাওলানা মান্নান রহ.। তিনি জীবদ্দশায় রাজনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। সাবেক ধর্ম মন্ত্রী ও ত্রাণ মন্ত্রী এম এ মান্নান রহ. বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের ছিলেন হৃদয়ের স্পন্দন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাণের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও মসজিদে গাউছুল আজম কমপ্লেক্সসহ বহু মসজিদ মাদরাসা। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা আলেমকূল শিরোমণি মাওলানা এম এ মান্নান রহ.-এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। তাঁর দক্ষতা, যোগ্যতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জুড়ি নেই। তিনি জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মাধ্যমে একসময়ের অবহেলিত মাদরাসা শিক্ষক ও কর্মচারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এনে দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বর্তমান সভাপতি আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীনের অব্যাহত সংগ্রাম ও প্রয়াসের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়।

আত্মপ্রত্যয়ী, নির্ভীক, সফল মাওলানা মান্নান (রহ.) জাতি, ধর্ম, দেশ ও সমাজের জন্য আজীবন দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে গেছেন অন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে। তীক্ষ্ণ মেধাবী ব্যক্তিটি দেশে ও বিদেশের ওলামা ও পীর-মাশায়েখের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। যেহেতু আমি দৈনিক ইনকিলাবের সাথে সংযুক্ত থেকে সাংবাদিকতায় জীবন ও যৌবন কাটালাম, সেহেতু পত্রিকাটির নাড়ি-নক্ষত্রের সাথে অতিপরিচিত। এর সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ইনকিলাব আমার অস্তিত্বের সারথী। হুজুরের ইন্তেকালবার্ষিকীতে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, আজকের এই দিনে সেটিই কামনা করি।
লেখক: দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ প্রতিনিধি ও সাবেক সভাপতি, প্রেসক্লাব যশোর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন