শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

শোক দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলির নামে নেতাকর্মীদের আত্মপ্রচার

প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : কেন্দ্রের নির্দেশ উপেক্ষা করে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর নামে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা আত্মপ্রচারণায় নেমেছেন। উঠতি ও পাতি নেতা ছাড়াও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের এ আত্মপ্রচারণার বড় বড় বিলবোর্ড, পোস্টার আর ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চত্বর, সরকারি অফিসের আশপাশ, এমনকি পাড়া-মহল্লার রাস্তায়ও। এসব আত্মপ্রচারের বিজ্ঞাপনে অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি এক কোণায় ছোট পরিসরে স্থান পেয়েছে।
আর বিজ্ঞাপনের বাকী অংশজুড়েই রয়েছে সুবিধাবাদী নেতাদের ছবি, নাম ও পদবি। আত্মপ্রচারের এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি কর্মীরাও। রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। কাঁদো বাঙ্গালী কাঁদো’ মৃত্যুহীন যে বীর প্রথমে গেয়েছেন জয় বাংলার গান, তিনিই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল শহীদ ভাইদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি-প্রচারে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড তেজগাঁও থানা, ঢাকা মহানগর উত্তর। এসব লেখা জাতীয় শোক দিবসের একটি ফেস্টুনে। এটি তেজগাঁও ও ফার্মগেট এলাকায় যত্রতত্র সাঁটানো হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৯ জনের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছবি দূর থেকে দেখা গেলেও প্রধানমন্ত্রীর ছবি দূর থেকে বোঝা মুশকিল। কিন্তু ওই পোস্টারে বড় করে শোভা পাচ্ছে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ফরিদুর রহমান খান ইরান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক মো. দোলন সরকার, ১ নম্বর ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান রাইয়ানের। তাদের ছবি বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড়। ওই ফেস্টুনে রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বেছাসেবক লীগ সভাপতি আবু কাওছার মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এবং তেজগাঁও থানার সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেনের ছবি। একইভাবে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের দুইপাশে সাঁটানো হয়েছে বিশাল বিশাল ব্যানার। একটি ব্যানার টানানো হয়েছে যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের পক্ষ থেকে। সে ব্যানারেও বঙ্গবন্ধু, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির ছবি ও এবং যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের ছবি সমানতালে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি বড়ই দৃষ্টিকটূ বলে মনে করছেন পথচারীরা।
ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের দিকে তাকালেই চোখ আটকে যায় একটি বিশাল বিলবোর্ডে। সিনেমা হলের সঙ্গেই টাঙ্গানোর হয়েছে বিশাল বিলবোর্ডটি। এতে লেখা রয়েছে, রক্তঝরা ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। বিদেশে পলাতক ১৫ আগস্টের খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে- ৯৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ, শের-ই বাংলা নগর থানা, ঢাকা মহানগর উত্তর। এই বিলবোর্ডে মোট ১০টি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ ফজলুল হক মনি, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, যুবলীগ উত্তরের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনের ছবি রয়েছে এতে। সবার থেকে বড় ছবি ওয়ার্ডের সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের।
শুধু ফার্মগেট এলাকায় নয়, এমন শত শত বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ওলি-গলিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অথচ দলের হাইকমান্ডের নিদের্শনা রয়েছে বিলবোর্ড, পোস্টারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কোনো নেতার ছবি দিয়ে আত্মপ্রচার করা যাবে না। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শোক দিবসের ব্যানার-পোস্টারে আত্মপ্রচারকারীদের হাসি মুখের ছবিও দেখা গেছে। স্বভাবতই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কি শোক দিবসের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে পারেন না। নাকি নিছক প্রচারের জন্য এই আয়োজন যেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে শোক দিবসকেও।
গত কয়েকদিন সরেজমিনে রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, প্রেসক্লাব, পল্টন, গুলিস্তান, কাকরাইল, মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, মালিবাগ, বনানী, মহাখালী, নতুনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে যেন আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অসংখ্য নেতা। এসব প্রচারণায় ১৫ আগস্টে শহীদদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যাদের সৌজন্যে এসব টানানো হয়েছে সেই নেতাদের ছবি। ব্যানার, ফেস্টুনে ছবিগুলো এমনভাবে স্থান পেয়েছে যে কে শহীদ আর কে জীবিত, অনেক ক্ষেত্রে তা বোঝা কষ্টকর।
রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চারপাশ এখন শোক দিবসের ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কিছু পোস্টার ও বিলবোর্ড চোখে পড়ে সেখানে। একই অবস্থা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের বেশ কিছু পোস্টার। যেখানে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে নেতাদের ছবিই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তাও কম নয়। রাজধানীর অনেক স্থানে দেখা গেছে, শুধুমাত্র জাতির জনকের ছবি দিয়ে নিচে নেতাদের নাম দেয়া হয়েছে। এমন একটি পোস্টার ও বিলবোর্ড পড়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান মোল্লা জানালেন, দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে শোকের পোস্টারে নিজের ছবি দেয়ার সুযোগ নেই। তাই জাতির পিতার ছবির সঙ্গে তার ছবি দেননি।
ওলামা লীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা দেলোয়ার হোসেন জানালেন, যারা শোক দিবস কি গুরুত্ব বুঝে উঠতে পানে না, তাদের মুখে হাসিমুখ থাকবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করি, তাই শোকের পোস্টারে ছবি দেইনি। ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রহমান চৌধুরী লাভলু জানালেন, আমি আগেই শোকের পোস্টারে আমার ছবি ব্যবহার না করতে নেতাকর্মীদের নিষেধ করেছি। আমি নিজেও যে পোস্টার-বিলবোর্ড বা ব্যানার টাঙ্গিয়েছি, সেগুলোতে নিজের ছবি ব্যবহার করিনি।
এদিকে, বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করে আর কোনো আত্মপ্রচার চালালে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আবারও কড়া হুঁশিয়ার দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদের
গতকাল রোববার বিকালে সচিবালয়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে তিনি এ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এ সভার আয়োজন করে।
সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নামে এতো পোস্টার, ব্যানার, বড় বড় বিলবোর্ড দেখলে ভয় হয়। তার প্রচারণার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে নিজের ছবি ব্যবহার করে আত্মপ্রচার করা হচ্ছে। এতে বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পায়। বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করে কোন আত্মপ্রচার সহ্য করা হবে না। অচিরেই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, সুসময় দেখলে বড় ভয় হয়। ৭৫’র ১৪ আগস্ট দেখেছি, আবার ১৫ আগস্ট দেখেছি। ১৪ আগস্টের চেনা মুখগুলো ১৫ আগস্ট অচেনা হয়ে গেল। কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা কতিপয় যুবক নিমতলা বস্তিতে থেকেছি, প্রতিবাদ করেছি। অনেক সত্য আছে, কিন্তু বলা যায় না। ১৪ আগস্টেও যারা ভোগ-বিলাস করেছে, ১৫ আগস্ট তারা কোথায় চলে গেলেন। আজ আবার সারাদেশে এতো আয়োজন, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন বিলবোর্ড।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন