বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভেজাল ওষুধ বিক্রি প্রতিরোধে আসছে ‘মডেল ফার্মেসি’

প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে ফার্মাসিস্টদের কাজে লাগানো জরুরী- প্রফেসর ড. মো. সাইফুল ইসলাম
হাসান সোহেল : ভেজাল ওষুধ বিক্রি প্রতিরোধে ‘মডেল ফার্মেসি’ ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ‘পাইলট’ প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে ৪০-৫০টি, প্রতিটি বিভাগে ১৫০ থেকে ২০০টি এবং জেলায় ২ হাজার মডেল ফার্মেসি স্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে আগামী দু’মাসের মধ্যেই এই কাজ শুরু হবে বলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া তিনটি ক্যাটাগরিতে মডেল ফার্মেসিকে ভাগ করা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে সফিসটিকেটেড ওষুধ থাকবে, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে সাধারণ ওষুধ থাকবে। এক্ষেত্রে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। এজন্য তাদের যথাযথ সম্মানির ব্যবস্থাও করা হবে। আর এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপি চিকিৎসক ও নার্সের পাশপাশি স্বাস্থ্য খাতের উন্নতিতে ফার্মাসিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে পৃথিবীর অনেক দেশই ফার্মাসিস্টের অভাবে তাদের ওষুধ শিল্পকে বিকশিত করতে পারছে না। সেখানে দক্ষ জনশক্তি ও বিদেশ থেকে এদেশে প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাই ওষুধের গুণগতমান ও সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের পাশাপাশি সব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এসব ফার্মেসি চালু হবে। তিনি বলেন, এই বছরের মধ্যে অন্তত ১৫০টি ‘এ গ্রেড’ এবং ২০০০টি ‘বি গ্রেড’ ফার্মেসি চালু করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এসব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগসহ ওষুধ বিক্রির সব ধরনের মান বজায় রাখা হবে। একই সঙ্গে ফার্মাসিস্টরা যে ওষুধ বিক্রি করবে সেই ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতাদের সংক্ষিপ্ত ধারণাও দেবে। ডা. মুস্তাফিজুর বলেন, যদি সফল হই, আমরা এটাকে ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে দেব। এই ব্যবস্থা ভুয়া ও নকল ওষুধ বিক্রি ঠেকাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সম্প্রতি মানহীন ওষুধ বাজারজাত করায় উচ্চ আদালত থেকে দেশের ৩৪টি ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনার পরও ফার্মেসিগুলোতে নিষিদ্ধ কোম্পানির ওষুধ পাওয়ার প্রেক্ষিতে এবং ফার্মেসিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আলাপকালে ডা. মুস্তাফিজুর রহমান এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ১ লাখ ২০ হাজার ফার্মেসি ওষুধ প্রশাসনের নিবন্ধিত। এদের মধ্যে এ গ্রেড ফার্মেসিগুলোকে স্নাতক সম্পন্ন করা ফার্মাসিস্ট এবং বি গ্রেড ফার্মেসিগুলোকে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে করে ওষুধ ক্রয় করতে গিয়েও রোগীরা ওষুধ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারেন।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, মডেল ফার্মেসির বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এতে ফার্মেসিগুলোতে কেমন ডেকোরেশন থাকবে, কতগুলো ফ্রিজ বা এসি থাকবে, ক্রেতাদের ব্রিফ করার জায়গা কোথায় কতটুকু থাকবে এবং ফার্মেসির আকার কেমন হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এছাড়া মডেল ফার্মেসিতে কেবল সরকার অনুমোদিত আসল ও মানসম্মত ওষুধ বিক্রি করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মো. রুহুল আমিন বলেন, মডেল ফার্মেসিগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকবে। এতে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত হবে। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি এতে বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোনো অসাধু ব্যক্তি বা ফার্মেসি চাইলেই ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। কেননা, সবাই মডেল ফার্মেসিতে গেলে অন্যদেরও এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে আসতে হবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে মোট ড্রাগ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৪২টি। আর লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা ৯ হাজার ৮০৫টি। জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, নতুন লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে ৪৪টি, নবায়ন হয়েছে ৩ হাজার ১৮টি। একই সঙ্গে অধিদপ্তর এ পর্যন্ত ড্রাগ কোর্টে মামলা করেছে ১১টি। আর মোবাইল কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে ১৭২টি। জরিমানা করা হয়েছে ৯০ লাখ ৫৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আর ৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৬৬ টাকার ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে উচ্চ আদালত থেকে ৩৪টি ওষুধ কোম্পানির সব ধরনের ওষুধের উৎপাদন বন্ধের এবং ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনার পর ওইসব কোম্পানির ওষুধ এখনও ফার্মেসিগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে। এ সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নিষিদ্ধ এসব ওষুধ ক্রয় বা বিক্রয় না করার জন্য ফার্মেসি এবং কোম্পানীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাজার থেকে সব ধরনের ওষুধ প্রত্যাহারে কোম্পানিগুলোকে সাতদিন সময় দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ওষুধ প্রত্যাহার না করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার তালিকা প্রত্যেক জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং র‌্যাবের মহাপরিচালককে পাঠানো হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি ফার্মেসিতে সেগুলো টানিয়ে রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বব্যাপি চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরেই ফার্মাসিস্টদের স্থান। উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে সম্পাদন করছে চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্স। তাই স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এদেশের ফার্মেসি সেবার মান বাড়ানো অতীব জরুরি, তা না হলে স্বাস্থ্যসেবা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমরা এ সংস্কৃতিটা চালু করতে পারিনি। দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সদের যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, তেমনভাবে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব দেয়া হয় না। একই সঙ্গে দেশের এলোপ্যাথিক কোম্পানিতে ফার্মাসিস্ট থাকলেও হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী এবং হারবাল জাতীয় ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোতে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা মাত্র হাতেগোনা। এ দেশের হাসপাতালগুলোতে ফার্মেসি সেবা বলতে বোঝায়, বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা এবং ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীর কাছে হস্তান্তর করা। মডেল ফার্মেসি এবং তাতে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দিলে এটা স্বাস্থ্য খাতের জন্য খুবই চমকপ্রদ হবে।
ড. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে ফার্মাসিস্টদের ব্যবহার আরও আগেই করা উচিত ছিলো। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্টরা চিকিৎসার জন্য ওষুধ ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান, ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজরদারি ও প্রতিরোধকরণে বিশেষ পারদর্শী। সর্বোপরি রোগীর চাহিদা অনুযায়ী ফার্মেসি সেবা প্রদান করতে হলে ফার্মাসিস্টের কোন বিকল্প নেই।
ফার্মেসি অনুষদের ডীন বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্বাস্থ্য পেশাজীবী হিসেবে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং নার্স এই চার শ্রেণীর পেশাজীবীর পূর্ণাঙ্গ টিম যতদিন না গঠিত হবে, ততদিন জনগণের জন্য কল্যাণকর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্ভব হবে না। সূত্র মতে, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ফার্মেসি বিভাগ খোলা হলেও বর্তমানে দেশের অনেকগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়ানো হচ্ছে। এই বিভাগগুলো দেশের ওষুধ শিল্পকে নিয়মিতভাবে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ করছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন