শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

জাহিলি যুগে আখেরী নবীর (সা.) শুভাগমন

পীরজাদা মুহাম্মদ এমদাদুল্লাহ্ শাজলী | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০২০, ১২:১৬ এএম

মহান আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা। মানুষ সৃষ্টি করে দীন, দাওয়াত ও নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য যুগে-যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসুলগণ মানব জাতির শিক্ষক। তারা আসমানী শিক্ষা তথা ওহির শিক্ষায় শিক্ষিত। সৃষ্টির প্রথম মানুষ ও নবী আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ রাসুল (সা.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুল পৃথিবীতে প্রেরিত হলেও পবিত্র কুরআনে মাত্র ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে। ঈসা (আ.) এর উর্ধ্বগমণের পর হতে আখিরী পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাশরীফ আনার পূর্ব পর্যন্ত ৫০০ বছর সময়কে ইতিহাসে আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত বা অন্ধকারের যুগ বলে। অথচ সে সময় চন্দ্র-সূর্য উদিত হয়েছে, যথারীতি আলো বিতরণ করেছে। তথাপিও উক্ত ৫০০ বছর সময়কে আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত বলার অসংখ্য কারণের মধ্যে ৩টি বিশেষ কারণ হলো- সে সময় দীন, দাওয়াত ও নৈতিক শিক্ষার অভাব ছিল অনেক বেশী। জাহিলিয়্যা একটি আরবী পারিভাষিক শব্দ। যা প্রায় সব ক্ষেত্রে ইসলাম শব্দের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। জাহিলিয়্যা বলতে বুঝায় প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের অবস্থা। আর আইয়্যামে জাহিলিয়্যা বলতে বুঝায় রাসুল পাক (সা.) এর আগমন পূর্ব ৫০০ বছরের অবস্থাকে। কুরআনুল কারিমে জাহিলিয়্যা শব্দটি ৪ বার উল্লেখ হয়েছে। (১) সুরা আল-ইমরানের ১৫৪ নং আয়াতে, (২) সুরা মায়িদার ৫০ নং আয়াতে, (৩) সুরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে এবং (৪) সুরা ফাত্হের ২৬ নং আয়াতে। জাহিলিয়্যা যুগের লোকদের বলে জাহেল। জাহেল শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। যথা- অজ্ঞানতা, মুর্খতা, কঠোরতা, দয়া-মায়া হীনতা, বর্বরতা, রূঢ়তা ইত্যাদি। জাহিলী যুগের আরবদের অধিকাংশই বেদুঈন এবং এদের প্রায় সকলেই ছিল নিরক্ষর। তারা গোত্রিয় জীবন-যাপন করত। তাদের মধ্যে পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ, হত্যা, লুণ্ঠন ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল। কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রথা চালু ছিল। কুরআন মাজিদের সুরা তাকভীরের ৮ ও ৯নং আয়াতে তার ইঙ্গিত রয়েছে। অত্যাচার, অবিচার, হত্যার বদলে হত্যা, জুয়া খেলা, মদ্যপান এবং কুসংস্কার জাহিলী সমাজের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট ছিল। নিষ্ঠুরতা মারামারি, কাটাকাটি, চুরি, ডাকাতি ছিল তাদের সাধারণ স্বভাব। তাদের অন্তরে মায়া-মমতার লেশমাত্রও ছিলনা। তারা ছিল মানবাকৃতির দানব বা হিংস্র প্রাণীতুল্য।
জাহিলী যুগে ব্যভিচার, অনাচার ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। জিনা করা ছিল তাদের গৌরবের বিষয়। ধর্ষনের পর প্রকাশ্যে সভায় স্বীয় বদমাশী এবং গুন্ডামীর কাহিনী বর্ণনা করাকে গৌরব মনে করত। অন্যদিকে পতিতা নারীগণ স্বীয় গৃহ দ্বারে পতাকা লটকিয়ে বসে থাকত। ইসলামের পূর্বে আরব সমাজে এরূপ দেহোপজীবিনী যৌন ব্যবসায়ী নারীর অভাব ছিলনা। “মারসাদ” নামক জনৈক সাহাবী রাসুল (সা.) এর নিকট ‘আনাক’ নামীয় এক পতিতাকে বিবাহ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। তখন কুরআনুল কারিমে এ আয়াত নাজিল হয়:- ব্যভিচারী ব্যভিচারিনীকে অথবা মুশরিক নারীকে ব্যতিত বিবাহ করেনা এবং ব্যভিচারিনী তাকে ব্যভিচারি অথবা মুশরিক ব্যতিত কেহ বিবাহ করেনা, মুমিনদের জন্য তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (সুরা নূর- আয়াত : ৩)
তদানীন্তন আরব সমাজে লজ্জা বলতে কোন বস্তু ছিলনা। সেকালের অসভ্য আরবগণ ও পবিত্র কা’বা ঘরের হজ¦ করাকে মহাপূন্য বলে মনে করত। কুরাইশ বংশীয় লোক ব্যতিত সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায় খানায়ে কা’বা তাওয়াফ করত। মহানবীর আবির্ভাব কালে সমগ্র পৃথিবীতে নারী জাতির অবস্থা ছিল অতিশোচনীয় ও মর্মান্তিক। বিবাহের সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত ছিল না। যার যত ইচ্ছে বিবাহ করতে পারত। “গায়লান সকফী” যখন ইসলাম গ্রহন করেন তখন তাঁর ১০ জন স্ত্রী ছিল। ওহাব আসাদী যখন মুসলমান হন তখন তাঁর ৮ জন স্ত্রী ছিল। সহোদর দুই বোনকে এক সঙ্গে বিবাহ করার প্রথা চালু ছিল।
স্বামী মৃত্যুর পর স্ত্রী নিজ স্বামীর ওয়ারিসদের ওয়ারিসী সম্পত্তিতে পরিণত হতো। তাদের কেহ ইচ্ছে করলে তাকে বিবাহ করত অথবা অপরের নিকট বিবাহ দিত অথবা আদৌ বিবাহ না দেয়ার ব্যাপারেও তাদের এখতিয়ার ছিল। কোন নারী বিধবা হলে ময়লা জীর্ণ কাপড় পরিধান করে একটি সংকীর্ণ অন্ধকার কক্ষে একবছর আবদ্ধ থাকতে হতো। ইতরতা ছিল তৎকালীন আরবদের স্বাভাবিক অভ্যাস। ভাল-মন্দ বিচার না করে সব ধরনের অখাদ্যই তারা ভক্ষন করত। কীট-পতঙ্গ, সর্বপ্রকার সরীসৃপ প্রাণী তাদের সাধারণ খাদ্য ছিল। জমাট রক্ত হালুয়ার ন্যায় টুকরা টুকরা ওঠায়ে খেত। গাধা, শুকর, কুকুর, শিয়াল, ইঁদুর, বাঁদুর বধ করে খাদ্য হিসেবে ভক্ষন করত। মদ্যপান ছিল আরবদের পুরানো অভ্যাস। অথচ অত্যাচার, ব্যভিচার, ঝগড়া, কলহ সর্বপ্রকার পাপের আকর হলো মদ। ঘরে ঘরে মদের আড্ডা বসত। ইসলামের শুরুতেও মদের প্রচলন বহাল ছিল।
মদ্যপানের প্রতি সারাদেশ অতিশয় আকৃষ্ট ছিল। এ জন্যই মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে একেবারে হঠাৎ কঠোর নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ন না হয়ে ক্রমান্বয়ে তিনবারে অবতীর্ন হয়েছে। মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবকালে নিখিল বিশ্ব অনাচার, অবিচার, জুলুম, অত্যাচারে তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আরবের ন্যায় পারস্য মিশর, রোম, ভারতবর্ষসহ গোটা দুনিয়ায় সভ্যতার আলো নিভে গিয়েছিল। অগ্নি উপাসনা, চন্দ্র পূজা, সূর্য পূজা, গাছ-মাছের পূজার অভিনব আবিষ্কার চালু হয়েছিল। ধর্ম সংক্রান্ত মতানৈক্য, রাজনৈতিক আত্মকলহ, পেশীশক্তির দাপট এবং দলাদলির দাবানলে দগ্ধ হয়ে দ্রুত গতিতে অবনতির পথে অগ্রসর হয়েছিল পৃথিবী। খাঁ খাঁ মরুভ‚মি, স্রষ্টার অথৈই জল, মাজলুম জনগোষ্ঠীর আত্মচিৎকার সবই যেন একজন উদ্ধারকারী মহামানবের শুভাগমনের প্রতিক্ষায় অশ্রুসজল চোখে পথচেয়ে ছিল দীর্ঘ বছর ধরে। মানব জাতিকে এহেন দুরাবস্থার বেড়াজাল থেকে মুক্তি, আখেরী জামানার দুর্বল বান্দাদের হিদায়াত, মাজলুমদের উদ্ধার, সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার জন্য আদি মানব আদম (আ.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ছয় হাজার একশত তের (৬১১৩) বছর পর সকল পয়গাম্বরের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গাম্বর সৃষ্টির দুলাল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহকে (সা.) আল্লাহ্ পাক রহমত সহ দুনিয়াতে পাঠালেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- আমি আপনাকে সমগ্র বিশ^বাসীদের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।
মহানবীর (সা.) শুভাগমন হয়েছিল ৫৭০ খ্রী: ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার। শীতের অবসান প্রায়, তরু শাখা প্রশাখায় নব পাতা পল্লব সমাগত। এমন এক দিনে রাতের শেষ প্রহরে হালকা শীতের স্নিগ্ধ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। পবিত্র মক্কা নগরীতে উচুঁ-নীচু ভুমিতে প্রভাতী আলোক শিখা শুভাগমী বার্তা নিয়ে কারা যেন ছড়িয়ে পড়েছিল। যার আগমণের অপূর্ব নুরে আসমান জমিন আলোকিত হয়েছিল। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল- “মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ্, শুভাগমণ! অভিনন্দন! কুল মাখলুকাত আজ আনন্দে আত্মহারা, গগণে গগণে ফেরেস্তাদের ছুটাছুটি, তোরনে তোরনে বাঁশি আর বাঁশি। সবই আজ বিস্মিত, পুলকিত, কম্পিত ও শিহরিত। জড় প্রকৃতির অন্তরেও লেগেছে দোলা। বেহেশ্তী খুশবুতে বাতাস আজ সুরভিত। যুগ-যুগান্তের প্রতীক্ষিত না আসা অতিথির আগমণ মূহুর্ত আজ যেন আসন্ন হয়ে ওঠেছে। তারই অভ্যর্থনার জন্য আজ সব আয়োজন। এমন স্নিগ্ধ শান্ত আমেজের মধ্যদিয়ে শুভ মূহুর্তে সোবহে-সাদেকের সময় আরবের মরু দিগন্তে মক্কা নগরীর এক জীর্ণ কুটিরের নিভৃত কক্ষে মা আমেনার কোলে তাশরীফ আনলেন প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। মহৎ ব্যক্তি বিশেষত: আম্বিয়াগণের শুভাগমণের মূহুর্তে বিষ্ময়কর ও আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। সৃষ্টির দুলালের আগমনের মূহুর্তে ও অভাবনীয় বিস্ময়কর ও অতি আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। মুহাদ্দিছগণের পরিভাষায় যাকে বলে- ইরহাসাত। পিয়ারা নবীর (সা.) জন্মলগ্নে সত্যের আগমন মিথ্যার কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল তামাম দুনিয়ার খোদাদ্রোহী শাষকদের অন্তরে। সৃষ্টির দুলালের শুভ পয়দায়েশের সময়ে পারস্যের রাজ প্রাসাদে ফাটল দেখা দেয়, উহার ১৪টি গম্বুজ ভ‚মিতে ধ্বসে পড়ে, পারস্য মন্দিরের অগ্নি নির্বাপিত হয়ে যায়, যা ইতিপূর্বে হাজার বছরেও নির্বাপিত হয়নি। কা’বা মন্দিরের দেব-মুর্তিগুলো ভুলণ্ঠিত হয়েছিল, সিরিয়ার মরুভূমিতে নহর প্রবাহিত হলো। সাওয়া নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হলো। সায়্যিদা আমেনার জীর্ণ কুটিরের আলোতে সিরিয়ার সব মহল ও রোম সাম্রাজ্যের প্রাসাদ সমূহ পর্যন্ত আলোকিত হলো। মা আমেনার কোলে তাশরীফ এনেছেন যে-নূর তার নাম মুহাম্মদ (সা.)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) একটি নাম। কোটি কোটি মানুষের ওষ্ঠদ্বয় প্রতিদিন বহুবার এ নামের আস্বাদ গ্রহণ করেন। এ নাম মুমিনের হৃদয়ে প্রবাহিত করে খুশি ও আনন্দের ফুল্লধারা। ১৪০০ বছর ধরে এভাবেই চলছে দুনিয়ার ইতিহাস। পৃথিবীর শেষ দিনটি পর্যন্ত অগনিত মানুষের মুখে মরুর দুলালের নামের উচ্চারণ এবং হৃদয়ের গভীরে তার অনুরাগ এমনিভাবে অব্যাহত থাকবে।
দু’জাহানের বাদশা, সায়্যিদা আমেনার নয়নমনি, রাসুল পাক (সা.) এর শুভ পয়দায়েশের দিন সোমবার দিবসটি ইতিহাস বিজড়িত। রাসুল পাক (সা.) এর শুভ জন্ম হয়েছে সোমবার, নবুওয়্যাত লাভ করেছেন সোমবার, মদিনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেছেন সোমবার, মদিনা মুনাওয়্যারায় তাশরীফ নিয়েছেন সোমবার, উম্মতদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরপারে যাত্রা করেছেন সোমবার এবং হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করেছেন সোমবার।
মানব সৃষ্টির ছয় হাজার এক শত তের (৬১১৩) বছর পর সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ওহির জ্ঞানে আলোকে আদর্শ সমাজ গড়ে যে শিক্ষা মানব জাতিকে দিয়েছেন সে শিক্ষার আলোকে পথ চলে আমরা ও হাউজে কাউসার পানকারী এবং তাঁর শাফায়াতের যোগ্য হতে পারি।
পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা ও আর্তি- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ হতে অক্ষম হস্তের এ লেখা তুমি কবুল কর, তুমিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ ও দোয়া কবুলকারী। আমিন!!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
রেজাউল ৬ নভেম্বর, ২০২০, ১১:৫২ এএম says : 0
নবী মুহাম্মদের(সাঃ)সম্পুর্ন জীবনীর উপর ধারাবাহিক লেখা চাই.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন