শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অ্যান্টিবায়োটিকে সর্বনাশ

প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রিতে সরকারের নির্দেশনা মানছেন না খুচরা বিক্রেতারা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরে তা প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি, অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স গ্রহণ, ব্যবস্থাপত্র সংরক্ষণ, বিক্রির পর রেকর্ড সংরক্ষণ, ওষুধের ব্যাচ নম্বর উল্লেখপূর্বক ক্যাশমেমো প্রদান, নির্দেশিত তাপমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও দেয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ওষুধের দোকানি ওই নির্দেশনা পালন করছে না। যদিও ওষুধ ক্রয়ের সাথে রোগীরা সঠিক ধারণা পাবে এবং ভেজাল ওষুধ বিক্রি বন্ধ হবে এই চিন্তা থেকে ইতোমধ্যে ‘মডেল ফার্মেসি’ চালু করার চিন্তা করেছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এতে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ বিক্রি, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোনো অসাধু ব্যক্তি বা ফার্মেসি চাইলেই ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। আর এ জন্য ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেয়া হবে। তাদের যথাযথ সম্মানীর ব্যবস্থাও করা হবে।
আর এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। দু’মাসের মধ্যেই পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে মোট ড্রাগ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৪২টি। আর লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা ৯ হাজার ৮০৫টি। জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, নতুন লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে ৪৪টি, নবায়ন করা হয়েছে ৩ হাজার ১৮টি।
সূত্রমতে, ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধবিদ্যা বিভাগের পক্ষ থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর এক গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৮৭ শতাংশ দোকানে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে গবেষণা করলে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে মনে করছেন গবেষণায় অংশ নেয়া ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আ ব ম ফারুক।
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী এমএস মেডিকেল হলের স্বত্বাধিকারী আবুল হোসেন জানান, অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনার বিষয়টি অধিকাংশ বিক্রেতার অজানা। এসব বিষয়ে বিক্রেতাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তবে যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা অভ্যাসে পরিণত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি ওষুধ বিক্রেতারা অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির পর কোনো নথি সংরক্ষণ করছে না। ব্যাচ নম্বরসহ কোনো ক্যাশ মেমোও দিচ্ছে না। সাদা ছোট কাগজে ওষুধের নাম ও মূল্য দিলে দিচ্ছেন তারা। সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার কোনো নাম চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এসব ওষুধ খেয়ে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে তাতে কাউকে দায়ী করার কিছুই থাকছে না। পাইকারি বিক্রেতাদের পথ অনুসরণ করছেন খুচরা বিক্রেতারাও। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো নজরদারিও নেই। জানতে চাইলে ওষুধ বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির উপ-সচিব এসএম মনির হোসেন বলেন, খুচরা বিক্রেতারা অ্যান্টিবায়োটিকের কুফর সম্পর্কে সচেতন নন। সরকারের নির্দেশনা মানতে খুচরা বিক্রেতাদের বাধ্য করতে হবে। এজন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে জরিমানা করে তা কার্যকর করতে হবে।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল খালেক প্রায়ই জ্বরাক্রান্ত থাকেন। জ্বর এলেই তিনি স্থানীয় বাজার থেকে কখনো একটি, আবার কখনো দুটি অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে থাকেন। জ্বর সেরে যাওয়ার পর তিনি আর ওই ওষুধ খাচ্ছেন না। এভাবে তার শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এখন সামান্য জ্বর হলে তার শরীরে অতি উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া তা নিবারণ করা যাচ্ছে না।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবাণু প্রতিরোধী। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা ও ভোক্তার অজ্ঞতার কারণে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন না করা, ওষুধের দোকানে ফার্মাসিস্ট না থাকা, অ্যান্টিকায়োটিকের কুফল সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং অর্থের লোভে তা যত্রতত্র বিক্রি করায় জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটি মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে বলে স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা মনে করছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আ ব ম ফারুক বলেন, ওষুধ একটি বিষাক্ত পদার্থ। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়া এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কারো ধারণা নেই। কিন্তু দেশের ওষুধের দোকানগুলো মূলত মুদি দোকানে পরিণত হয়েছে। একজন ক্রেতা মুদি দোকান থেকে যেভাবে পণ্য কিনতে পারে, ওষুধের দোকান থেকেও একই কায়দায় তা কেনা সম্ভব হচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। সরকারকে এভাবে কঠোর অবস্থানে আসতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, অ্যান্টিবায়েটিক বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনা মেনে চলার জন্য তারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে তারা গণমাধ্যমে এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন বার্তা পৌছে দিচ্ছেন। এছাড়া ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তদারকি করতে অধিদফতরে একজন পরিচালকের নেতৃত্বে একটি টিম কাজ করছে। তারা দেশের সরকারি-বেসরকারি ৩০টি হাসপাতালে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। এছাড়া মুঠোফোনে অনেকে ক্ষুদে বার্তায় তথ্য প্রদান করতে পারবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন