বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিএনপি কার্যালয় যেন ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’

প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফজাল বারী
নয়া পল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়; এক সময় নেতাকর্মীর পদভারে থাকতো মুখরিত। অফিসে বসা দূরের কথা দাঁড়িয়ে সময় পার করতে হতো শত শত নেতাকে। সেই অফিস এখন প্রায় সব সময় থাকে ফাঁকা। নতুন কমিটি ঘোষণার পর উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে আসেন না। কারণ গ্রেফতারের ভয়। অফিসের সামনে সব সময় পুলিশি প্রহরা রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তারপর পার্টি অফিসের আশপাশে সব সময় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় গোয়েন্দাদের গাড়ী। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে-পশ্চিম পার্শ্বে গাড়ীর পাশাপাশি গরম পানির গাড়ি সদা প্রস্তুত থাকে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা। একজন নেতার বিরুদ্ধে ২০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত মামলা ঝুলছে। এর আগে এই কার্যালয় থেকে দলের মহাসচিব (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত) মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ১৫৪ জন নেতাকে সারিবদ্ধভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো রাজনীতিক অঙ্গনে নজির হয়ে আছে।
মামলার কারণে দলীয় অফিসে সব সময় কাটানো সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী পার্টি অফিসে আসতে পারেন না। নেতাকর্মীরা অফিসে এলেই ‘গ্রেফতার’ যেন নিয়ম হয়ে গেছে। সব সময় গ্রেফতারের ভীতি আতঙ্কে থাকা নেতাদের প্রশ্ন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কি নো ম্যানস ল্যা-? সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের পা দিতে মানা! ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির মানসিকতা?
দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ৭ বছর পর পেয়েছে নতুন নেতৃত্ব। গত ৬ আগস্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রবীণের সমন্বয়ে তারুণ্য নির্ভর এই কমিটি নিয়ে চলমান আন্দোলনের গতি আরো বাড়ানোর চেষ্টায় দলটি। কিন্তু দলটির নতুন নেতৃত্বের উপর নতুন খড়গ নেমে এসেছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। দিবানিশি তাড়া করে বেড়ায় গুম, খুন, ক্রসফায়ার। রাজনীতির কেন্দ্রস্থল দলীয় কার্যালয় হলেও নেতাদের দিনকাটে আদালত চত্বরে। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার মতোই পরিস্থিতি জেলা-উপজেলা শহরেও।
এদিকে নতুন কমিটি ঘোষণার পর নড়ে চড়ে বসেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৬ আগস্ট থেকেই পোশাকধারী, সাদা-পোশাকী এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার শত শত সদস্য বিচরণ করছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং তার আশপাশে। মাঝে মধ্যেই নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। পলাতক নেতার বাসায় তল্লাশি করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনতর যে দলটির কার্যালয় যেনো ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ এরিয়া। শিষেঢালা প্রাচীর ভেদ করেই দলের যৌথসভাতে হাজির হয়েছিলো কয়েকশত গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রাপ্ত নতুন নেতা। দীর্ঘ বৈঠক করে তিন দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে নেতারা। তবে লক্ষ্য করা গেছে, অনেক নেতাই ওই সভাতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের ঘোষিত ১৯ স্থায়ী কমিটি, ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিল এবং ৫০২ সদস্যের কার্য নির্বাহী কমিটিসহ মোট ৫৯২ নেতার মধ্যে সবাই ১০ থেকে শতাধিক মামলার আসামি। জামিনে আছেন এমন নেতারাই কেবল প্রথম যৌথসভাতে হাজির হতে পেরেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপি নেতাদের মধ্যে কার কার বিরুদ্ধে মামলা তা বলা কঠিন। তবে সহজ হলো বিএনপির বিরুদ্ধেই মামলা। মানে যে বিএনপিকে সমর্থন করবেন তিনিই আসামি।
আরেক যুগ্ম-মহাসচিব শত মামলার আসামি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপি নেতাদের দিনকাটে আদালত চত্বরে রাত কাটে ফেরারি হিসেবে। গত ৯ বছর ধরেই বিএনপি নেতারা এই বৈরী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। নতুন নেতৃত্ব এখন আর পেছনে নয় সামনের দিকে যাবে। বাধা যতোই আসুক।
দলের সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, আমাদের দলের কার্যালয়ে নেতাকর্মীরা স্বচ্ছন্দে আসতে পারে না। চারপাশে হান্ডকাপ হাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অপেক্ষমাণ। এ দৃশ্য অবশ্যই নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। দলটির কার্যালয় যেনো ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ ঘোষণা করা হয়েছে কীনা তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন।
বিএনপি দলীয় আইনজীবীরা জানান, গত বছরে টানা অবরোধের সময় নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী এডভোকেট শামসুজ্জামান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল, বিএনপির তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা, ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক সম্পাদক এমএ কাইয়ুম কমিশনারসহ ৬৭ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। গ্রেফতার এড়াতে অনেক আগেই আত্মগোপনে আছেন- হাবীব উন নবী খান সোহেল, এম এ কাইয়ূম ও মারুফ কামাল খান হোসেন।
এর আগে গত মঙ্গলবার একই অভিযোগে বেগম সেলিমা রহমানসহ দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা, ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক সম্পাদক এম এ কাইয়ুম ও তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালসহ আরও ১৫ নেতার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার মহানগর হাকিম খোরশেদ আলম।
গত ১১ আগস্ট ঢাকা মহানগর ১ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের (মহানগর দায়রা জজ) বিচারক কামরুল হোসেন মোল্লা অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে মামলায় রিজভীর জামিন বাতিল করেন। মতিঝিল থানার মামলায় রিজভী ছাড়া আরও ৫৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন বিচারক। এ মামলায় মোট আসামি ৯২ জন। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশানে রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন। গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন রিজভী আহম্মেদ। তার বদলে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আরেক যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

নাশকতা, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মোট ১২ মামলায় হাজিরা দিতে গত ১০ আগস্ট পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় হাজির হন বিএনপি প্রধান তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১০ মামলায় জামিন পেয়েছেন। বাকি দুটো রয়েছে শুনানির অপেক্ষায়। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দুইবছর আগে ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। দলের মহাসচিবের বিরুদ্ধেই ৮৭ মামলা এবং ২৫টি মামলার দেয়া হয়েছে চার্জশিট। কেন্দ্রীয় কমিটিই নয় থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের বেলায় একই খড়গ। কেন্দ্রীয় নেতারা মামলার ঘানি টানছেন; আর তৃণমূল নেতারা ঘরবাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বন-বাদাড়ে দিনরাত যাপন করছেন। কারো কারো প্রতিষ্ঠান বেদখলে চলে গেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, প্রায় এক হাজারের উপরে বিএনপি নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে, ৫শ’ অধিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গুম হয়ে গেছে, হাজারের উপরে পঙ্গু হয়েছে, অসংখ্য আহত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ আসামি হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ জেলে গেছে।
তিনি আরো জানান, এমন কোনো বিরোধী দলের কোন নেতা নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা নাই। আজকে সত্যিকার অর্থে এই মামলা, এই হামলা, জমি দখল করে নেয়া, ব্যবসা দখল করে নেয়া- এটা গত ৭/৮ বছরের মধ্যে বিরোধীদলকে সব দিক থেকে পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে।
দলীয় সূত্রমতে, আন্দোলরত দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সারাদেশে লক্ষ্যাধিক মামলা দায়ের এমন নজীর নেই। দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সর্বনিম্ন ১০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে লাখ লাখ নেতাকর্মী মামলার আসামি। অনেক নেতাকর্মীকে সপ্তাহের ৪ থেকে ৫ দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়। তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে যখন ঘণ্টারপর ঘণ্টা কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়; সাধারণ কর্মীর বেলায় সে দৃশ্য কী হতে পারে তা বলা বাহুল্য।
আজ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক আজ রাতে অনুষ্ঠিত হবে। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ বৈঠক ডেকেছেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির নতুন কমিটির এটিই প্রথম বৈঠক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Noor Ul Islam ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১০:২৩ এএম says : 0
তা বিএনপিরই ব্যর্থতা।
Total Reply(0)
Mizan ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১:৩৩ পিএম says : 0
Sobar akta kotha mone rakha uchit je, ai din din na aro din ase
Total Reply(0)
Rashid ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ১:৩৪ পিএম says : 0
BNP ke aro basi kousoli hote hobe
Total Reply(0)
Shahos Ahmed ১৮ আগস্ট, ২০১৬, ২:১৩ পিএম says : 1
Toy, Rizbi sahebra haspateler fees na dia polano thik chilona. R mittha rajnity korley amon hobei.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন