আফ্রো-এশিয়ার মজলুমদের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদা ও নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হয়েছে। গতকাল রাজধানী ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, জাগপাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলোচনা সভার আয়োজন করে। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাজার প্রাঙ্গনে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএনপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ভাসানী পরিষদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন।
দিবসটি পালনে ভোর থেকেই টাঙ্গাইলের সন্তোষে ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গনে রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মাজার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার ভক্ত, অনুরাগী ও সাধারণ মানুষের ঢল নামে।
দিবসটি উপলক্ষে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল, ভোজ, বুক স্টল, চিত্র প্রদর্শণীর আয়োজন করা হয়। সকাল সাড়ে ৭টায় ভাসানীর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. আলাউদ্দিন। এসময় তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর ভাসানী পরিবার, জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সিরাজুল হক আলমগীর, শাহজাহান আনসারী, জামিলুর রহমান মিরন, নাহার আহমেদ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়াও গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ, জেলা জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি, পিপলস পার্টি, গণসংহতি, ন্যাপ ভাসানী, ভাসানী ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
মাজার জিয়ারত শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, বিএনপি জ্বালাও পোড়াও রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এক লাখের উপরে মামলা দেয়া হয়েছে। মামলার ভয়ে আমরা রাজপথ ছাড়িনি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাইনি। ১২ বছর ধরে রাজপথে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি। প্রয়োজনে আরও ১২ বছর সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। ভোটবিহীন সরকারকে পতন ঘটানোর জন্য নেতা-কর্মীদের মওলানা ভাসানীর আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জনগণের কণ্ঠকে রোধ করে গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়েছে। চারিদিকে অরাজকতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ মাফিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, বর্তমান সরকার দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। নির্বাচন কমিশনার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তামাশা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। বিদেশি শক্তি ও দেশিয় বিশেষ বাহিনীকে খুশি করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ওয়ার্কার্স পার্টি : মওলানা ভাসানী স্মরণে ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে স্মরণসভার আয়োজন করে। এতে প্রধান আলোচক বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একজন আন্তর্জাতিক নেতা ছিলে। তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের একজন নেতা ছিলেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তিনি এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের সেসময় বিখ্যাত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের সঙ্গে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন বিষয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটি নিয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার জন্য মাও সেতুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তিনি ভিয়েতনামের হো চি মিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, জাপানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার অবদান এটা কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। তিনি আরও বলেন, মওলানা ভাসানী জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের নিয়ে লড়াই করেছেন, তিনি স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেছেন; ভাষা আন্দোলনে তিনি প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধিকারের আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন। সুতরাং মওলানা ভাসানীকে অবহেলা করলে, তার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং জাতি হিসেবে আমাদেরই ক্ষতি হবে।
সৈয়দ মাকসুদ বলেন, পাকিস্তান হওয়ার পর মওলানা ভাসানী পার্লামেন্টের মেম্বার হয়েছিলেন। সেই পার্লামেন্টের ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কয়েকটি অধিবেশনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। সংসদ অধিবেশনের তিনি বলেছিলেন আমরা কী সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এর গোলাম? এখান থেকে তোমরা পাটের টাকা, চায়ের টাকা, চামড়া বিক্রির টাকা নিয়ে যাবে কেন? মওলানা ভাসানী প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আঘাত করলে তোমরা প্রত্যাঘাত করো। জালেম যখন মজলুমের ওপর অত্যাচার করবে, তখন তাকে আঘাত করা নৈতিক কর্তব্য। জালেমের সঙ্গে অহিংস আন্দোলন করলে তাকে পরাজিত করা অত্যন্ত কঠিন। আমি এই অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করি না।
রাশেদ খান মেনন এমপির সভাপতিত্বে আলোচক হিসেবে আরো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল।
রাশেদ খান মেনন বলেন, মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল স্বাধীনতার ভিত্তি ভূমি স্থাপনে। তার ওপরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সৌধ নির্মাণ করেছেন। সুতরাং তাকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস হয় না, এ কথা আমাদেরকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। মওলানা ভাসানী এদেশের মানুষের কাছে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। যুগ যুগ জিও তুমি মওলানা ভাসানী।
বাসদ : ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রি দল (বাসদ) ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে তোপখানা রোডস্থ বাসদ ভবনের নীচ তলায় মওলানা ভাসানীর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাসদ ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক বজলুর রশীদ ফিরোজের সভাপতিত্বেব অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জুলফিকার আলী, খালেকুজ্জামান লিপন, নাসিরউদ্দিন প্রিন্স প্রমূখ।
আলোচনা সভায় বক্তারা মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ ৯৬ বছরের জীবন ও সংগ্রাম এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, তিনি আজীবন আপোষহীন, অসাম্প্রদায়িক ও বিদ্রোহী মানুষ ছিলেন। তিনি যুবক বয়সে জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন, আসামে গিয়ে ভূমিহীন কৃষক জনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পাকিস্তানী শাসকদের উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সিয়াটো, সেন্টু চুক্তি সমর্থন করায় তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি পাকিস্তানে প্রথম গণতান্ত্রিক বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ভাসানী কাগমারি সম্মেলন থেকে পাকিস্তানকে যে ‘ওয়ালাইকুম আচ্ছালাম’ বলেছিলেন। বক্তাগণ আরো বলেন, তিনি স্বাধীন দেশে দুর্নীতি, লুটপাট ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ভারতের জন্য আতঙ্ক ছিলেন। ভারতের একতরফা ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালের মে মাসে দুদিনব্যাপী লংমার্চ করেছেন।
ন্যাপ : ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা করেছে বাংলাদেশ ন্যাপ। দলটির মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেছেন, ভাসানী ছিলেন দুঃসাহসী ও চিরবিদ্রোহী রাজনীতিবিদ। ভাসানীর সংগ্রামী আদর্শের মৃত্যু নেই। রাজধানীর নয়াপল্টনের যাদু মিয়া মিলনায়তনে স্মরণ সভায় বলা হয়, এই দেশ ও এই জাতি যত দিন টিকে থাকবে, মওলানা ভাসানীকে কেউ অবহেলা কিংবা অবজ্ঞা করতে পারবে না। ইতিহাসই তার সঠিক মূল্যায়ন করবে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ ন্যাপ ঢাকা মহানগর সভাপতি মো. শহীদুননবী ডাবলু’র সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এম. এ জলিল, ন্যাপ ভাইস চেয়ারম্যান স্বপন কুমার সাহা, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. কামাল ভুইয়া, ঢাকা মহানগর নেতা হারুনুর রশিদ মৃধা, মো. হারুন-অর-রশিদ প্রমূখ।
এ ছাড়াও জাগপা, গণদলসব বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভার আয়োজন করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন