শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব

ড. আবুল কালাম | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি- এ তিন ধর্মের অনুসারীদের কাছেই ফিলিস্তিন পূণ্যভূমি হিসেবে গণ্য। ফলে এর কর্তৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা রকম দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলে আসছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। প্রাচীন যুগের রীতি অনুযায়ী ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা বিজয়ী হয়েছে তারাই এর কর্তৃত্ব করেছে।
এশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিনের মোট আয়তন মাত্র ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে ফিলিস্তিনকে তিনটি খন্ডে বিভক্ত করা যায়। বাখতারি তীর- যার অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চল। গাজা উপত্যকা- যা আয়তাকৃতির একটি উপকূলীয় অঞ্চল। বাখতারি তীর ও গাজা উপত্যকায় বসবাসরত জনসংখ্যার ৯৫% মুসলমান এবং ৫% খ্রিস্টান। ফিলিস্তিনের অন্য ভূখন্ড ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা জবরদখল করে নেয়, যা ‘ইসরাইল’ নামক দেশ হিসেবে পরিচিতিলাভ করেছে। বর্তমানে গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও গোলান মালভূমি ইসরাইলের দখলে রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছিল, ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশ জমিতে গঠিত হবে ইহুদি রাষ্ট্র, বাকি জমি আরব স¤প্রদায়ের জন্য। যদিও সে সময় ইহুদি সম্প্রদায়ের অধীনে সমগ্র ফিলিস্তিনের মাত্র ৭ শতাংশ জমি ছিল। আদি আরব বাসিন্দাদের জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়া হয়েছিল জায়নবাদীদের হাতে। পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মাত্র এক বছরের মধ্যে মূল ফিলিস্তিন ভূখন্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয় ইসরাইলি দখলদার বাহিনী। পুরোটিই বেআইনি দখলদারি। এখনও প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে চলেছে ইসরাইল। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হিসেবে নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির সংখ্যা এখন ৭০ লাখেরও বেশি।
জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন ভূখন্ডকে দুই ভাগ করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। জায়নবাদী দখলদাররা ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরাইল গঠন করলেও পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখনও সম্ভব হয়নি। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভা ফিলিস্তিনের মানুষের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ২৯ নভেম্বর তারিখটিকে বিশ্বজুড়ে সংহতি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ফিলিস্তিনকে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের (Observer State) মর্যাদা দেওয়া হয়। ইসরাইল ও আমেরিকার সক্রিয় বিরোধিতা উপেক্ষা করেই জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দেয়, বিপক্ষে পড়ে মাত্র আটটি ভোট। কিন্তু পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও কী সুবিধা পাচ্ছে ফিলিস্তিন তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ইসরাইলসহ পাশ্চাত্য শক্তির নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলা করে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন। কিন্তু এই স্বপ্ন পূর্ণ হবে কবে? সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ও নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে ফিলিস্তিনি জনগণ যাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, সে লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করতে সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস’ প্রতিবছর পালিত হয়ে থাকে।
৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ফিলিস্তিন সর্বপ্রথম ইসলামী খিলাফতের অধিকারভুক্ত হয়। অতঃপর দীর্ঘ চারশ’ বছর পর ১০৯৬ সালে ক্রসেডাররা (ঈৎঁংধফবং) মুসলামানদের হাত থেকে ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পুনরায় ১১৮৭ সালে গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নেতৃত্বে মুসলামানরা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে। ১৫১৭ সালে উসমানী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ১৯১৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন কার্যত ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে থিওডর হর্জল মৃ. ১৯০৪ (Theodor Herzl) নামক একজন ইহুদি সাংবাদিক ভিয়েনার ইহুদিদের নিয়ে শুরু করেন জায়নিজম (Zionism) নামে একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে থিওডর দাবি করলেন, ফিলিস্তিন ছিল ইহুদিদের আদি নিবাস। অতএব সব ইহুদিকে সেখানে ফিরে যেতে হবে, গড়তে হবে পৃথক আবাসভূমি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিলাতে এসিটনের দারুণ অভাব দেখা দেয়। ওই সময় জায়োনিস্ট আন্দোলনের কুখ্যাত নেতা ও রসায়নবিদ হাইম ওয়াইজম্যান ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, তিনি এসিটন উৎপাদন করতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারকে তিনি এ বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে রাজি হন, তবে শর্ত দেন যে, যুদ্ধে জিতলে ফিলিস্তিনে গড়তে দিতে হবে ইহুদিদের আবাসভূমি।

থিওডর ও ইহুদিদের দাবি অনুযায়ী, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নানান স্বার্থ সামনে রেখে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এটাকে ‘বেলফোর ঘোষণা’ (Belfour Declaration) বলা হয়। এখান থেকেই ফিলিস্তিন সমস্যার সূচনা। ব্রিটিশ সরকারের এই নীতির ফলে আরবদের অসন্তোষ বেড়ে চলল। এ অসন্তোষ প্রকাশ পেল ১৯২১, ১৯২৯ ও ১৯৩৬ এর আরব-ইহুদি দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিরা আমেরিকার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সাহায্য লাভ করে। আমেরিকারও মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ঘাঁটির প্রয়োজন ছিল। সুতরাং আমেরিকা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি সৃষ্টির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালো। ১৯৪২ সালে ডা. হাইম ওয়াইজম্যান (Dr. Haim Weissman) এবং আরও কয়েকজন ইহুদি নেতা আমেরিকার সাথে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং সেখানে বিটমোর প্রোগ্রাম (Bitmore Programme) নামে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। এ প্রস্তাব অনুসারে আমেরিকা ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের বিশেষ আবাসভূমি গড়ে দেবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালে আরব লীগ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে আরব লীগের তীব্র বিরোধিতা সত্তে¡ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে ইসরাইল নামে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস হয়। এভাবেই ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটির জন্ম হয়। যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন হাইম ওয়াইজম্যান।

জন্মের পর থেকেই ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বৈরী আরব শক্তি পরিবেষ্টিত অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্রই হচ্ছে রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইলের টিকে থাকার চাবিকাঠি। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় জড়িত হয়ে পড়ে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বহু মেধাবী ইহুদি বিজ্ঞানী ফিলিস্তিন ভূখন্ডে অভিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্নেস্ট ডেভিড বার্গম্যান। তিনিই হলেন ইসরাইলের পারমাণবিক বোমার আবিষ্কারক। ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও উপদেষ্টা বার্গম্যান পরামর্শ দেন যে, পারমাণবিক জ্বালানি হতে পারে ইসরাইলের অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দুর্বল সামরিক শক্তির একটি বিকল্প। পারমাণবিক বোমা তৈরি করা ছিল এ পরিকল্পনার অংশবিশেষ। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইহুদি বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম মজুদের জন্য নেগেভ মরুভূমি খুঁজে বের করেন। ১৯৫০ সাল নাগাদ তারা বিরশেবার কাছে ও সিডনে নিন্মমানের ইউরেনিয়াম ভান্ডার খুঁজে পান। ১৯৪৯ সাল নাগাদ বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক গবেষণাকে সমর্থন করে। ইসরাইল সরকারের ব্যয়ে পারমাণবিক প্রকৌশল ও পদার্থ বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য প্রগতিশীল ইসরাইলি ছাত্ররা বিদেশে গমন করে। ১৯৫২ সালে ইসরাইল গোপনে আণবিক শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। আণবিক শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়েই ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

ষাটের দশকে দেশটি পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। সে বছর মিসরসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধের শুরুতেই ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমিতে পারমাণবিক প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল মিসরীয় বাহিনীর। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কর্নেল জামাল আবদুন নাসের পরিকল্পনাটি বাতিল করে দেন। ভেবেছিলেন, ইসরাইল তখনো পারমাণবিক বোমা বানাতে পারেনি। তাই নেগেভ মরুভূমিতে দিমোনা প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেওয়া নিরর্থক হবে। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, ইতোমধ্যেই ইসরাইল দু’টি পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে এবং বোমা দু’টি নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুতও করে রেখেছে। ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিজয়ী হতে পারেনি। এ যুদ্ধেও ইসরাইলের বিজয়ের মূলে ছিল দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র। যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইসরাইল ১৩টি পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। প্রতিটি বোমার ক্ষমতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার সমান।

২০১২ সালে জাতিসংঘ উদ্যোগে ফিলিস্তিন ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ মর্যাদা পায়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিন সমস্যার কোনও উন্নতি হয়নি, বরং অবস্থার অবনতিই হয়েছে। ২০১৭ সালে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী বলে ঘোষণা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং বাহরাইনের সঙ্গে ইসরাইলের চুক্তির পিছনে হাত সেই ট্রাম্পেরই। কয়েকদিন আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইসরাইল সফরে গিয়ে আচমকাই পশ্চিম তীরে যান। এই প্রথম কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিম তীরে পদার্পণ করলেন। আন্তর্জাতিক মহলে পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনিদের ভূমি হিসাবে চিহ্নিত। সেখানে গিয়ে পম্পেও মন্তব্য করেন ‘পশ্চিম তীর ও গোলান মালভূমি ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ’। আরব বিশ্বসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলোও এ সফরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এমতাবস্থায় ‘আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস’ উপলক্ষে এই আশা রাখি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত জো বাইডেন প্রশাসন ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ সদর্থক ভূমিকা নেবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন