মো. দেলোয়ার হোসেন, গাজীপুর থেকে :বালুদস্যুদের আগ্রাসনে অশান্ত হয়ে উঠছে শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র। ইজারা ছাড়াই প্রতিদিন লুট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার বালু। শুধু বালু নয়; প্রকৃত ইজারাদারদের ড্রেজার ও নৌযানও লুটে নিচ্ছে বালুদস্যুরা। প্রশাসনের সহযোগিতা না পেয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়ছেন ইজারাদারেরা। পুলিশ সরাসরি বালু দস্যুদের সহযোগিতা করছে এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগও করছেন তারা।
সূত্র জানায়, কাপাসিয়ার কুড়িয়াদি খেয়াঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যায় বালু ও ট্রলার লুটের ঘটনায় গত ৮ আগস্ট কাপাসিয়া থানায় একটি মামলা নং-০৬ হয়। এর আগে গত বছর ২২ নভেম্বর শ্রীপুর, কাপাসিয়া ও পাগলা (ময়মনসিংহ) থানার সংযোগস্থল ত্রিমোহনি এলাকায় শীতলক্ষ্যায় বালু উত্তোলনের সময় চিহ্নিত বালু দস্যুদের হাতে খুন হন পাগলা থানার বেলদিয়া গ্রামের শাহ আলম ঢালী। এ ঘটনায় শাহ আলমের স্ত্রী রওশন আক্তার মিতু বাদী হয়ে চিহ্নিত বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে কাপাসিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা নং- ২২ (১১)১৫ দায়ের করেন। বর্তমানে এই মামলার আসামিরা কাপাসিয়ার টোক নয়নবাজার সংলগ্ন বানার নদি (ব্রহ্মপুত্র অংশে) এলাকায় বীরদর্পে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু লুটে নিচ্ছে। এদেরকে সরাসরি সহযোগিতা করছেন নদীর ওপারে পাগলা থানার পুলিশ। ব্রহ্মপুত্র নদের ওই অংশের ইজারাদার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আফাজ উদ্দিন। তিনি বালু লুটের ঘটনায় পাগলা থানার ওসি চাঁন মিয়া ও এসআই রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করেছেন। পুলিশের ময়মনসিংহ বিভাগের ডিআইজি ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কাছে পৃথক লিখিত অভিযোগে তিনি জানান, গত বছরের চেয়ে ২০ লাখ টাকা বেশি দরে তিনি বানার নদী বালু মহালের ইজারাদার নিযুক্ত হন। টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর তিনি যাতে টাকা জমা দিতে না পারেন সেজন্য তাকে জেলে আটকে রাখার ষড়যন্ত্র শুরু করে বালুদস্যুরা। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গত ৩১ মে তাকে আটক করেন পাগলা থানার ওসি চাঁন মিয়া। পরে তাকে একটি ছিনতাই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত ৯ জানুয়ারি স্থানীয় মুখী কাজলা ব্রিজে বিকাশ পরিবেশকের ১৪ লাখ টাকা ছিনতাই ঘটনায় পাগলা থানায় মামলাটি হয়েছিল। মামলাটি পরে ডিবিতে স্থানান্তর হয়। পাগলা ওসির পরামর্শে ডিবির তদন্তকারী অফিসার এসআই ফারুক আহমেদ ব্যবসায়ী আফাজ উদ্দিনকে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করেন। শুনানী শেষে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রিমান্ড না মঞ্জুর এবং তার জামিন মঞ্জুর করেন। এভাবে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে আফাজ উদ্দিন দ্রুত টেন্ডারের টাকা দাখিল করেন। এর পর গফরগাঁও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ১৯ জুলাই বালু মহালটি তাকে বুঝিয়ে দেন। ঐ দিনই তিনি লোডিং ড্রেজারের সাহায্যে বালু উত্তোলন শুরু করলে বালুদস্যুরা তাকে বাধা দেয়। তিনি বাধা উপেক্ষা করেই বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখলে ২০ জুলাই পাগলা থানার ওসি চাঁন মিয়া মোবাইল (০১৭১১৪৬৬৪০৮) ফোনে তাকে (০১৭৩৪৫৩৫৯৮৪) কোন কারণ ছাড়াই বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখলে ওই দিনই পাগলা থানার এসআই রেজাউল করিম সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ড্রেজার, নৌযান ও বালু শ্রমিকদের মারধর করেন এবং জোরপূর্বক বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেন। এর পর থেকে তিনি পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের কারণে অদ্যাবধি বালু মহালের ধারে কাছেও যেতে পারছেন না। এভাবে পুলিশের সহযোগিতায় বালুদস্যুরা প্রতিদিন চার লাখ টাকা মূল্যের প্রায় চার লাখ ঘনফুট বালু প্রকাশ্যে লুটে নিচ্ছে; অভিযোগ করেন ইজারাদার আফাজ।
এদিকে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বালুদস্যুরা চারটি লোডিং ড্রেজারের সাহায্যে বালু উত্তোলন করছে এবং ৬ থেকে ৮ হাজার ফিট ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বিভিন্ন ট্রলারের সাহায্যে এসব বালু শ্রীপুর ও ভালুকার বিভিন্ন গদিতে নেয়া হচ্ছে। শ্রীপুরের নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামে এবং ভালুকা থানা সংলগ্ন ব্রিজের দুই পাশে নদীর তীর ঘেঁষে এসব লুণ্ঠিত বালুর পাহাড় গড়ে তুলা হচ্ছে। ভালুকায় এধরণের ৬টি বালুর গদি পাওয়া গেছে। ভালুকা এন্টারপ্রাইজের মালিক ভালুকা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান খান রিপন। উক্ত ভালুকা এন্টারপ্রাইজের গদিতে গিয়ে কথা হয় যুবলীগ নেতা রিপনের চাচাতো ভাই দেলোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি ইজারাদার আফাজ উদ্দিনের প্রসঙ্গে বলেন, ভাল মানুষের এই ব্যবসায় আসা উচিত নয়। সন্ত্রাসী ও ক্যাডারবাহিনী ছাড়া বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আফাজের সন্ত্রাসীবাহিনী নেই। ফলে তিনি এই ব্যবসা ধরে রাখতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, আমরা ড্রেজার থেকে বালু কিনে এনে ব্যবসা করি। বালু মহাল কে ইজারা পেল তা আমাদের দেখার বিষয় নয়।
পাগলা থানার ওসি চাঁন মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ড্রেজার বা বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য নয়; বরং বালু মহালে ডাকাতরা অবস্থান করছে এই গোপন সংবাদে সেখানে এসআই রেজাউল করিমকে পাঠিয়েছিলাম। ব্যবসায়ী আফাজকে তিনি গ্রেফতার করেননি উল্লেখ করে বলেন, এটি ডিবি পুলিশের ব্যাপার।
এদিকে গাজীপুর জেলার বালু মহালগুলোতেও প্রকাশ্যে লুটপাট চলছে। জেলার মোট ৪টি বালু মহালের মধ্যে ২টি নিয়ে মামলা চলছে এবং বাকি দুটিতে বিনা টেন্ডারেই বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। শীতলক্ষ্যার কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ এলাকায় যে দুটি বালু মহাল নিয়ে মামলা চলছে সেখানেও একাধিক ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে। স্থানীয় থানা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসকে ম্যানেজ করে বালু মহালগুলোতে প্রকাশ্যেই লুটপাটের মহোৎসব চলছে। এতে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শীতলক্ষ্যার লুণ্ঠিত বালুতে কাপাসিয়া-নারায়ণপুর রোডে অর্ধশতাধিক বালুর গদি গড়ে উঠেছে। এসব গদির উপর্যুপুরি বালুর ট্রাকে কাপাসিয়া-নারায়নপুর রোডটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এতে রোডটি সাধারণ যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বালুদস্যুদের এসব তৎপরতার কারণে সরকার একদিকে নদীতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে ডাঙ্গায় রাস্তা মেরামতের পেছনেও মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে।
এদিকে টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বালু মহালের ইজারা পেয়েও বালুদস্যুদের কারণে মহালের দখল নিতে পারছেন না নতুন ইজারাদাররা। ফলে আগামীতে উপযুক্ত দর দিয়ে টেন্ডারে নতুন উদ্যোক্তারা অংশ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে প্রভাবশালী সিন্ডিকের কবলে পড়ে সরকার প্রতি বছর বালু মহাল থেকে লাখ লাখ টাকার রজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। গত বছর আলোচিত বানার নদী বালুমহাল (মৌজা : টাঙ্গাব, চাকুয়া, কুরচাই, পাতলাশি) ২২ লাখ টাকায় ইজারাদার নিযুক্ত হন পাগলা থানার তললি গ্রামের হারুন মেকার ওরফে হারুন মোল্লা। বর্তমানে ৪১ লাখ টাকায় মহালটির ইজারা পান পাতলাসি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আফাজ উদ্দিন। তিনি ভ্যাটসহ ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা জমা দিয়েও এখনো বালু মহালের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছেন না। বর্তমানে বালু উত্তোলনের ভরা মৌসুম শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগের ইজারাদার হারুন মোল্লা টেন্ডারে হেরে গিয়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীবাহিনী দিয়ে বালু মহালে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করছেন বলেও অভিযোগ করেন নতুন ইজারাদার আফাজ উদ্দিন। এব্যাপারে তিনি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গত ৮ আগস্ট হারুন মোল্লা ও পাগলা থানার এসআই রেজাউল করিমসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ জেলার বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা নং ১৭২/১৬ দায়ের করেছেন। আদালত তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে হারুন মোল্লা বলেন, আফাজ উদ্দিনকে বালু ব্যবসায়ীরা চিনেন না। তার কাছ থেকে কেউ বালু নিতে চান না। ফলে আমার কাছ থেকে সবাই বালু নিচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন