বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিএনপির কমিটি নিয়ে বিতর্ক ‘ত্যাগী’ নেতার মানদন্ড কী

প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : রাজনীতিতে ‘ত্যাগী’ শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি গঠনের সময় দাবী ওঠে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষা, মেধা, যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতার চেয়ে ত্যাগ শব্দটির প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে নেতাদের এই ‘ত্যাগের’ মানদ- কী? কোন নিক্তিতে রাজনৈতিক দলে নেতাদের ‘ত্যাগ’ পরিমাপ করা হয়? বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণার পর বিতর্ক এমন পর্যায়ে গেছে যে কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নই করা হয়নি, এ অভিযোগ সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে। যারা এ বিতর্কের ঝড় তুলছেন তাদের মনোভাব হলো নতুন কমিটিতে যারা পদ-পদবি পেয়েছেন তারা যেন উড়ে এসে জুড়ে বসে ‘পদ’ বাগিয়ে নিয়েছেন। সত্যিই কি তাই? বিএনপির সাবেক এমপি রাজশাহীর আবু হেনা তো বলেই দিলেন ‘বিএনপির নতুন কমিটি গঠন’ মাফিয়া চক্রের কাজ। বিএনপি ব্যাপক জনপ্রিয় দল। তিন বছর আগে দেশে যেসব জরিপ হয়েছে তাতে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। সেই বিএনপি যারা পরিচালনা করছেন তারা মাফিয়া চক্র?
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ‘নেতাদের নেতা’। মওলানা ভাসানী তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন; তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। অ্যানালগ ওই যুগেই নেতারা যোগ্যতা দিয়েই আসীন হন রাজনীতির শীর্ষে। শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ’৭১ সালে পরাধীনতার শিকল ছেঁড়ার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। মেধা, সাংগঠনিক ক্ষমতা আর দলেই শুধু নয়, দেশের জন্য তাদের ছিল অপরিসীম আত্মত্যাগ। তাদের নেতৃত্বের মানদ- পৈতৃক পরিচয় ও বংশ মর্যাদায় আসেনি। তারা গণমানুষের মুক্তির জন্য জেল-জুলুম সয়েও নেতৃত্বে নিষ্ঠার পরিচয় দেন; দলকে এগিয়ে নেন। মওলানা ভাসানীকে ঢাকায় বাড়ি করার জন্য পাকিস্তান সরকার ধানম-িতে দুই বিঘা জমি বরাদ্দের প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভাসানী বলেছিলেন ‘ঢাকায় আমার বাড়ির দরকার নেই। আমি চাই মানুষের অধিকার।’ নেননি জমি। ২০১৫ সালে বর্তমান সরকার ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ তিনি বিনয়ের সঙ্গে সে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন তিনি ব্যাক্তিগতভাবে কোনো পুরস্কারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি। অথচ এখন দেশদরদী ত্যাগী নেতাদের সরকারি প্লটের জন্য, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য কী দৌড়ঝাঁপ!
এখন ডিজিটাল যুগ চলছে। এ যুগে নেতাদের ত্যাগের মানদ- নির্ধারণ হবে কীভাবে? দেশ প্রেমের কথা বাদ। দলের জন্য ত্যাগ কীভাবে বোঝা যাবে? দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর ‘নেতা হওয়ার মানদ-’, ‘ত্যাগী নেতা’ ইত্যাদি শব্দগুলো নিয়ে হৈচৈ চলছে। তর্ক-বিতর্ক চলছে টিভির টকশো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট, সম্পাদকীয়-উপ-সম্পাদকীয়তে। ত্যাগী নেতাদের নাকি মূল্যায়ন করা হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও দফায় দফায় কাউন্সিলের তারিখ পরিবর্তন করলেও যারা আওয়ামী লীগের দোষ খুঁজে পান না; তারাই হাজার হাজার লাখ লাখ মামলার ভারে ন্যূব্জ বিএনপির কমিটি নিয়ে বিতর্ক করছেন। তাদের বক্তব্য বিএনপি নতুন কমিটিতে যোগ্য এবং ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে ত্যাগী নেতার মানদ- কী? শনিবার একটি পত্রিকায় বিএনপির সাবেক এমপি আবু হেনার লেখা ঢাউস উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়। বিএনপির দুই বারের সাবেক এই এমপি লেখায় বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বকে কেবল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করেননি; কমিটি গঠনকে বলেছেন ‘মাফিয়া চক্রের কাজ’। তাকে কি মাফিয়া চক্র দলীয় নমিনেশন দিয়ে দুইবার এমপি করেছিল রাজশাহীর বাগমারা আসনে? সত্যিই কি বিএনপির নেতৃত্বে এখন মাফিয়া চক্র! বিএনপির যোগ্য ও ত্যাগী নেতার উদাহরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে উপদেষ্টা করা হয়েছে; অথচ রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানকে করা হয়েছে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। সত্যিই তাই! ১/১১ পট-পরিবর্তনের সময় বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে একটি পাঁচতারা হোটেলে পালিয়ে থেকে বিদেশ পলায়ন করা রাজশাহীর এই নেতা কি জানেন না যাকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে তিনি শুধু রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন না; তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নেতা যে ছাত্রদের সরাসরি ভোটে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। আর যে নেতাকে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন তার সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানেন? আবার এক নেতার প্রসঙ্গ টেনে জানান, ওই নেতা দুঃখ করে বলেছেন ‘আমার কর্মীরা স্থায়ী কমিটি অথচ আমি---’। ১/১১ বেগম জিয়া গ্রেফতারের পর দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই গিয়ে ওই নেতা কত বছর লুকিয়ে ছিলেন সেখবর কি জানেন সাবেক আমলা আবু হেনা? বিএনপির নতুন কমিটিতে অনেক যোগ্য নেতা বাদ পড়েছেন। বড় দলে সেটাই স্বাভাবিক। তবে কমিটিতে যারা পদ পেয়েছেন তারা সবাই অযোগ্য? দলের জন্য তাদের কোনো ত্যাগ নেই?
দেশের রাজনীতিতে ত্যাগী (!) নেতার মানদ-ের ছোট্ট দুটি নমুনা। ঢাকার গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এমন নেতাকে রংপুরের একটি সংসদীয় আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী করা হয়। দলের মনোনয়ন বোর্ডে তাকে প্রশ্ন করা হয় ‘আপনি ধানম-ি থানার নেতা; আপনাকে উত্তরাঞ্চলে দলীয় নমিনেশন দেয়া হবে কেন?’ জবাবে ওই নেতা জানান, তিনি ভোট করতে চান এই কারণে যে নির্বাচনে তার মার্কা বিজয়ী না হলে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করতে দেবেন না। ব্যালট পেপার জ্বালিয়ে দেবেন। শুনেই ঢাকার গুলশান থানার ওই সভাপতির দলীয় নমিনেশন নিশ্চিত করা হয়। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে আগে গাইবান্ধার একটি আসনে একজনের নমিনেশন দেয়া হয় এই যোগ্যতায় যে ওই নেতা সাঈদীর ফাঁসি ইস্যুতে আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের কয়েকটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেন। তারই পুরস্কার স্বরূপ নমিনেশন পান। অতঃপর এমপি হয়ে ওই নেতা একশিশুর পায়ে গুলি করে পত্রিকার শিরোনাম হন। ওই দুই নেতা কোন ত্যাগের জন্য দলে মূল্যায়িত হয়েছেন? এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তবে দলের জন্য যারা নিবেদিত, পরীক্ষিত তাদের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কারণ মেধা, যোগ্যতা, সততা ও ত্যাগের মূল্যায়ন না হলে রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে না।
প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক দলে ত্যাগী নেতা কারা? যারা নিত্যদিন নেত্রীর স্তুতি গাইছেন এবং প্রতিপক্ষের মু-ুপাত করছেন তারা? যারা দলের জন্য সর্বোচ্চ নির্যাতিত হন এবং তাদের পরিবার নির্যাতিত হয় তারা। জেল জুলুম সহ্য করেও দলের আদর্শ নীতি কৌশলে অটুট থেকে কর্মসূচি পালনে সোচ্চার ছিলেন তারা। যারা শ্রমঘাম দিয়ে দল টিকেয়ে রেখেছেন তারা। যারা দলের কঠিন সময়ও সংগ্রাম করেছেন দলকে বুকে আঁকড়ে রেখেছেন চোর-সুবিধাবাদীর মত পালিয়ে যাননি তারা। যারা টাকা দিয়ে নয় সততা দিয়ে মানুষকে ভালোবাসায় জনগণ ‘নেতা’ নাম উপহার দিয়েছে তারা। যারা দল ক্ষমতায় থাকুক না থাকুক সব সময় দলের জন্য কাজ করেছেন তারা। যারা ‘মল ত্যাগের’ মতো দল ত্যাগ করেন; দুর্দিনে পালিয়ে নিরাপদে থাকেন; বিপদ দেখলে কেটে পড়েন তারা। ত্যাগী নেতা চেনার উপায় কী?
রাজনৈতিক দলে বিরোধ, গ্রুপিং লবিং থাকবেই। বড় দলগুলোতে এ সমস্যা আরো বেশি। আবার বড় দলে শত শত হাজার হাজার যোগ্য নেতা থাকেন; যারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার যোগ্য। সকলেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রত্যাশিত পদ পাবেন এমনও নয়। তবে দলের কমিটি গঠনে গ্রুপিং লবিং এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে; থাকে আগামীর রাজনীতির হিসেব-নিকেষ। কিন্তু পরীক্ষিত এবং ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যন্ত এটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে দলে নেতাদের ত্যাগের মানদ- কীভাবে নির্ধারিত হয় সেটাই দেখার বিষয়। অবশ্য যাদের রাজনীতি দলে ‘পদ’ ভোগ করা তাদের ব্যাপার আলাদা। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন ‘শান্তি ত্যাগ থেকে আসে, একে ভোগে খুঁজো না’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Kawsir ২১ আগস্ট, ২০১৬, ১:২১ এএম says : 1
পরীক্ষিত এবং ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
Total Reply(0)
Rubel ২১ আগস্ট, ২০১৬, ২:৪২ পিএম says : 0
boro dole asob thakbe e......
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন