প্রতি হেক্টর জমিতে আলু বীজ রোপণ করতে খরচ হয় ১৬ হাজার ৯০০ টাকা। আধুনিক যন্ত্র দিয়ে একই কাজ করলে খরচ নেমে আসে চার হাজার ৮০০ টাকায়। সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে, যন্ত্র ব্যবহারে আলু রোপণের খরচ ৬৭ শতাংশ কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে কম খরচে আলুর শতভাগ উৎপাদন অর্জন সম্ভব।
সূত্র মতে, আলু একইসঙ্গে শীতকালীন এবং স্বল্পমেয়াদী ফসল। আলু রোপণ করতে হয় অল্প সময়ের মধ্যে। আলু রোপণের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিও ব্যয়বহুল এবং বেশ শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। বর্তমানে বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি আলুর গড় ফলন মাত্র ১১ টন। আলু বীজ হাতে রোপণ করা হয়। পরিপক্ক হয়ে গেলে আলু ক্ষেতের মাটি কোদাল বা লাঙল দিয়ে আলগা করতে হয়। এ পদ্ধতিতে অনেক আলু থেঁতলে যায়, কেটে যায় বা ফেটেও যায়। এতে বীজও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে আলুর বীজ লাগানো, উৎপাদন বৃদ্ধি ও একই সঙ্গে আলু নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে ফলন ২০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং (এফএমপিই) বিভাগ আলুসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে সহায়ক এমন কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছে। যেহেতু দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ডিজেল ইঞ্জিন এবং পাওয়ার টিলার পাওয়া যায়, তাই আলুচাষের যন্ত্রপাতিগুলো পাওয়ার টিলারের ইঞ্জিনকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করা যায় অনায়াসেই। এতে একদিকে পাওয়ার টিলারের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে আবার কৃষকরা স্বল্পখরচে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছেন। দেশে জমি চাষ ও আলু উত্তোলন, সার প্রয়োগ এবং বীজ বপনের জন্য আলাদা আলাদা ছোট মেশিন পাওয়া যায়। এসব যন্ত্র দিয়ে উৎপাদনের শতভাগ আলু উত্তোলন সম্ভব।
বারি’র ফার্মমেশিনারি এন্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক বলেন, কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা দিন দিন কমছে। বারি উদ্ভাবিত আলু উত্তোলন যন্ত্র অত্যন্ত শ্রমিক সাশ্রয়ী। প্রচলিত পদ্ধতিতে মাটির নিচে প্রায় ১০ শতাংশ আলু থেকে যায় কিন্তু যন্ত্র ব্যবহারে একেবারেই ছোট-বড় সব আলু উঠে আসে। যন্ত্র চালাতে ঘন্টায় মাত্র দেড় থেকে ২ লিটার ডিজেল লাগে। যন্ত্রটির দ্বারা এক বিঘা জমিতে আলু রোপণ করতে ১ থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগে।
তিনি বলেন, বারির সাথে চুক্তিভুক্ত যন্ত্র প্রস্তুতকারীরা এরইমধ্যে এসব যন্ত্র তৈরি ও বাজারজাত শুরু করেছে। ফলে এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে। এতে উৎপাদনও আগের চেয়ে বাড়ছে। ড. এরশাদুল বলেন, নতুন উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির মান যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য নমুনা দেয়ার সময় প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং যথাযথ নির্দেশনা দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠছে এবং এগুলোর চাহিদাও বাড়ছে।
লক্ষ্য রাখতে হবে রোগে
কিন্তু যন্ত্রের সব চেষ্টা বৃথা হয়ে যাবে, যদি মাঠে নিরোগ, সুস্থ আলু জন্মানো সম্ভব না হয়। আরলি ব্লাইট বা আগাম ধ্বসা, লেইট ব্লাইট অর্থাৎ নাবি ধ্বসা বা মড়ক রোগ আলু চাষের জন্য মূর্তিমান আতংক।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ব বিভাগের প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, আগাম ধ্বসা ও নাবী ধ্বসা- দুটি রোগই ছত্রাকজনিত। আক্রান্ত আলু বীজ ও আক্রান্ত গাছ থেকে রোগটি ছড়ায়। বাতাস ও পানির মাধ্যমেও জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টিপাত ও কুয়াশা রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে। অধিক ফলনশীল গাছগুলো আক্রমণের শিকার বেশি হয়।
তিনি বলেন, সংকটাপন্ন আবহাওয়া, দিনের বেলাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও মেঘলা আকাশ এই রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটায়। গাছ আক্রান্ত হওয়ার পর ছত্রাকনাশক প্রয়োগে খুব বেশি ভালো ফল পাওয়া যায় না। এছাড়া লিফ রোল বা পাতা মোড়ানো রোগ, কমন স্কেব, অন্তর ফাঁপা রোগ, ভেতরের কালো রোগ, সুতলি পোকার আক্রমণ ছাড়াও বেশ কয়েকটি রোগ ও পোকার আক্রমণ হতে পারে। এসব রোগের ধরণ বুঝে নিজ জেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে নিয়ম ও পরিমাণ মেনে কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োগ করা উচিত তাহলেই কৃষক আলুর কাঙ্খিত ফলন পাবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলুসহ যে কোনো রবিশস্যের জন্যেই কৃষকদেরকে সরকারিভাবে নানা রকম বালাইনাশক সংক্রান্ত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। সরকার দিচ্ছেও। তবে সেটা সীমিত। তবে ডিজিটালাইজেশনের এ সময়ে শুধু সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। এখন কৃষি কথনের মতো বিভিন্ন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কৃষক বা কৃষি বিষয়ক উদ্যোক্তরা সহজেই কৃষিবিষয়ক তথ্য পেয়ে যাচ্ছেন। এসব পোকামাকড় ও এর প্রতিকার সম্পর্কে ধারণাও মিলছে সেখানে। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকরা নিজেরাই অনেক বালাইনাশক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন