ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা সংখ্যালঘুদের জানমালের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এমনকি তাদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তার বিধান ঘোষণা করেছে। বিশ^নবি (সা.) যখন কোনো জেহাদে সৈন্যদল পাঠাতেন তখন সেনাপতিকে স্পষ্টভাষায় বলে দিতেন যে, অমুসলিমদের কোনো উপাসনালয়ে হামলা করবে না; কোনো ঋষি সাধকের ওপর আক্রমণ করবে না; কোনো ফলদার বৃক্ষ বিনষ্ট করবে না; কোনো নারী ও শিশুকে হত্যা করবে না। মহানবি (সা.)-এর এ নিয়মের দ্বারা প্রমাণিত যে, ইসলামই একমাত্র অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা ও তাদের উপাসনালয়ের সুরক্ষায় যথার্থ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অবশ্য ইসলামি স্বকীয়তায় প্রতিমা, ভাস্কর্য ও মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট অমুসলিমদের জন্য তা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হিসেবে অক্ষুণ্ণ থাকবে। ইদানীং কতিপয় বুদ্ধিজীবী মূর্তি, প্রতিমা ও ভাস্কর্যের পরিচয় গুলিয়ে ফেলছেন। কুরআন-সুন্নাহর ভুরিভুরি প্রমাণ প্রতিমা ও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে কিছু মিথ্যা গল্প, অস্পষ্ট বিবরণ আর রহিত বিধানের উপর ভিত্তি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তারা ভাস্কর্য বা মূর্তিকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ প্রমাণ করার জন্য মোটামুটি চারটি বিষয় পেশ করে যাচ্ছে। নিচে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার আলোচনা ও ভ্রান্তির অপনোদন তুলে ধরা হলো।
এক. হজরত আয়েশা রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর ঘরে পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। সেই পুতুলগুলোর মধ্যে একটা ডানাবিশিষ্ট ঘোড়ার পুতুলও ছিল। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. এগুলো দেখেছেন কিন্তু নিষেধ করেননি। বুখারি-মুসলিমসহ অনেক হাদিসগ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ আছে।
দুই. রাসুল সা. পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের ভিতর ও আশপাশ থেকে যখন সকল মূর্তি অপসারণ করেন তখন বাইতুল্লাহর ভিতরে হজরত ঈসা আ. এবং মেরি ( হজরত মারয়াম ) এর প্রতিকৃতি ভাঙতে নিষেধ করেন। সিরাতে ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বরাতে উপরোক্ত বর্ণনাটি তারা উল্লেখ করে থাকেন। তিন. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হজরত সুলায়মান আ. এর ঘটনা। যেখানে বলা হয়েছে নবী সুলায়মান আর. এর নির্দেশে জিনরা আকৃতি নির্মাণ করত।
চার. মুসলিম খলিফাদের শাসনকাল থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অমুসলিমদের দেশ বিজয়ের পর সেখানকার মূর্তি অপসারণ করা হয়নি। বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য স্থাপিত রয়েছে।
ভ্রান্তির অপনোদন : মূর্তিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি আর প্রমাণগুলো পড়লে বুঝা যায়, তারা কুরআন হাদিস কিছু ঘাটাঘাটি করেছেন। তবে তা করেছেন কুরআন সুন্নাহর সঠিক বক্তব্য অনুসন্ধানের জন্য নয়, বরং নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তার স্বপক্ষে কিছু বিভ্রান্তিমূলক সূত্র সন্ধানের নিমিত্তে। এ ধরনের কর্মকন্ড খুবই গর্হিত। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কেই বলা হয়েছে ‘আল্লাহ কুরআনের দ্বারা অনেককে সঠিক পথ দেখান, আবার অনেককে ভুল পথে চালান। আর যারা অপরাধী কেবল তাদেরকেই কুরআনেরর দ্বারা বিভ্রান্ত করেন। [সুরা বাকারা]
হজরত আয়েশা রা. এর পুতুল সংক্রান্ত বিবরণগুলো যেকোনো সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠক পড়লেই বুঝবেন, নয় দশ বছরের এক বালিকার খেলার জন্য স্বহস্তে বানানো ছিল পুতুলগুলো। পুতুল বলতে হুবহু মানুষ বা কোনো প্রাণীর আকৃতি ছিল না সেগুলো। বরং শিশুদের কঁচি হাতে কাপড় চোপড় দিয়ে তৈরি ছিল এবং নিঃসন্দেহে তাতে কোনো মুখায়বয়ব ছিল না। যদি পুতুলগুলোতে প্রাণীর আকৃতি দৃশ্যমান থাকত তবে তা কস্মিকালেও নবীজি সা. এর ঘরে থাকতে পারত না। পূর্ণাকৃতির পুতুলতো দূরের কথা, কাপড়ে অঙ্কিত প্রাণীর দৃশ্যও তো রাসুল সা. বরদাশত করেননি। খোদ হজরত আয়েশা রা. কে এ জন্য কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
হজরত আয়েশা রা. প্রাণীর আকৃতি যুক্ত একটি চাদর ক্রয় করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সা. তা দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘরে ঢুকলেন না। আয়েশা রা. নবীজির সা. চেহারায় ক্ষোভ লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের নিকট তওবা করছি, আমার থেকে কী অপরাধ প্রকাশ পেয়েছে? নবীজি সা. বললেন, এ চাদরের কী দশা? আয়েশা রা. বললেন, আমি এটা কিনেছি আপনার বসার ও হেলান দেয়ার জন্য। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, এই আকৃতি অঙ্কনকারীদেরকে কেয়ামতের দিন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। [বুখারি : ৫৯৬১]
পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের দেয়ালে হজরত ঈসা ও মারয়াম আ. এর অঙ্কিত ছবির বিষয়ে মূর্তিপন্থীদের প্রচারণাকে সত্যের অপলাপ বলা ছাড়া উপায় নেই। প্রথমত, সিরাতে ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশামের বরাতে যা কিছু বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তা আদৌ সঠিক তথ্য নয়। বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ঈসা ও মেরির (মারয়ামের) ছবি বাইতুল্লাহর দেয়ালে রেখে দেয়ার কল্পিত যে কাহিনীটি তারা বর্ণনা করেছেন, সেটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রেস থেকে প্রকাশিত ইংলিশ লেখক আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ‘দি লাইফ অব মোহাম্মদ’ গ্রন্থের বর্ণনা।
[প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫৫২] আলফ্রেড গিয়োম সিরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষেপিত রূপ সিরাতে ইবনে হিশামের অনুবাদ করেছেন ঠিক, কিন্তু তাতে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। এমন অনেক বর্ণনা তিনি এই গ্রন্থে সংযুক্ত করেছেন যা মূলগ্রন্থ সিরাতে ইবনে ইসহাকেও নেই। সিরাতে ইবনে হিশামের কোনো পান্ডুলিপি বা মুদ্রিত সংস্করণেও নেই। ঈসা আ. ও মেরির ছবি রেখে দেওয়ার বর্ণনাটিও আলফ্রেড গিয়োমের সংযোজন, যা তিনি আযরাকি কৃত ‘আখবারু মক্কা’ থেকে সংগ্রহ করে ইবনে ইসহাকের নামে চালিয়ে দিয়েছেন এবং বর্ণনাটির সূত্রও যাচাই করে দেখা গেছে সেটি সবৈর্ব ভুয়া ও জাল। প্রশ্ন ওখানেই যে, বিশুদ্ধ বর্ণনার অগণিত হাদিস হাতের নাগালে থাকতে আলফ্রেড গিয়োমের এই বর্ণনাটি বুদ্ধিজীবীদের কেন পছন্দ হলো? এটাকে অজ্ঞতা বলব না জ্ঞানপাপ বলব?
২০০৮ সালে হুমায়ুন আহমেদও এই নির্জলা মিথ্যা তথ্যের বরাত দিয়ে মূর্তির বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন। তখন বিষয়টি নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন ও প্রচার করেছিলেন মুহতারাম হজরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক, (মাসিক আল কাউসার : ডিসেম্বর ২০০৮)। আট বছর পর আবার সেই একই কাসুন্দি ঘেটে ২০১৭ এর ২৩ ফেব্রæয়ারি হাসান মাহমুদ বিভ্রান্তি ছড়ালেন! (কালের কণ্ঠ)। একেই বুঝি বলে চোখ থাকিতে অন্ধ!
হজরত সুলাইমান আর. এর যুগে পবিত্র কুরআনে জিন জাতি কর্তৃক আকৃতি গঠনের বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। তবে এটাতো নবী সুলাইমান আ. এর আনীত শরিয়তের ঘটনা। এদ্বারা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর আনীত শরিয়তে মুহাম্মাদিয়ায় কী রূপে প্রমাণিত হবে। অথচ পূর্বের শরিয়ত ও বর্তমান শরিয়তে ভাস্কর্য সংক্রান্ত বিধানের পার্থক্য কার্যকারণসহ বিবৃত হয়ে আছে ‘হজরত ইবনে আব্বাস রা. পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ওয়াদ্দ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর সম্পর্কে বলেছেন, এরা সবাই নূহ জাতির নেককার বান্দা ছিলেন। যখন তাদের মৃত্যু হলো তখন শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে তারা যে সমস্ত স্থানে বসত সেখানে তাদের মূর্তি বানিয়ে রাখে। আর ঐ মূর্তিগুলোকে তাদের নামেই নামকরণ করে। তখনও তাদের ইবাদত শুরু হয়নি। এর পর যখন ঐ জমানার লোকরাও মারা গেল, তাদের পরের লোকেরা ভুলে গলে যে, কেন এই মূর্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল। আর এভাবেই তাদের পূজা শুরু হয়ে গেল। [বুখারি ; হাদিস ৪৯২০]
পূর্ববর্তী অনেক শরিয়তে মূর্তির বৈধতা ছিল। আরও অনেক কিছুরই বৈধতা ছিল। কিন্তু আমাদের শরিয়তে মুহাম্মাদিয়াতে মূর্তির অবৈধতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। রহিত বিধানের ঘটনা দিয়ে প্রমাণ পেশ করা অজ্ঞতার পরিচায়কই বটে। পবিত্র কুরআনে এমন আরও অনেক ঘটনার বিবরণ আছে, যেগুলো বর্তমান শরিয়তে বলবৎ নেই। মূর্তির বিষয়টিও তেমন।
থাকল মুসলিম খলিফাদের যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে মূর্তি থাকার ঘটনা। এ বিষয়ে খলিফা হজরত আলী রা. এর একটি ঘটনার বিবরণ পড়ে দেখি আবুল হাইয়াজ আসাদি বলেন, আলী ইবনে আবি তালেব রা. আমাকে বলেছেন, আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে নবী সা. আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সমাধি সৌধ মাটির সাথে মিশিয়ে দিবে এবং সকল ছবি মুছে ফেলবে। [মুসলিম : হাদিস ৯৬৯]
এটাই হলো ইসলামি উম্মাহর প্রকৃত চিত্র। বাকি সংখ্যালঘু অমুসলিমদের উপসানালয়সমূহে সংরক্ষিত মূর্তি সেগুলো ইসলাম কোনো কালেই ভাঙতে বলেনি, আজও ইসলামবেত্তাগণ বলেন না। মূর্তিপন্থীরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিভ্রান্তি তৈরির মতো কছিু উপাদান পেয়েছেন, সেগুলোই মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করছেন। অথচ তারা যদি সত্যসন্ধানী হতেন তাহলে আরও সহজেই অনেক বিবরণ পেতেন যা ইসলামের সঠিক ও অকাট্য বিধান প্রমাণ করে। পাঠকের সুবিধার্থে এমন কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন