বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইতিহাসে ইহুদি জাতি

প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল্লাহ্ আল মেহেদী
ইতিহাসে একটি দুর্ধর্ষ জাতি ইহুদি, প্রাক ঐতিহাসিক যুগ হতে এরা বেশ বেপরোয়া ও হিং¯্র প্রকৃতির। অত্যাচার, আক্রমণ, জিঘাংসা ও অন্য ধর্মের প্রতি ক্ষোভ আদিকাল হতেই এদের মনে বিরাজ করে আসছে। বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে ইহুদিদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও অপকর্মের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কোরআনে কারিমে তাদের অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জঘণ্য মনোবৃত্তি ওদের। চড়া সুদখোর ও ধনলিপ্সু জাতি হিসেবেও তাদের একটা পরিচয় রয়েছে। বর্বর এ জাতি  যুগ যুগ ধরে খোদাদ্রোহিতা, কুফরি ও তাদের খারাপ কর্মকা-ের জন্য মানুষের কাছে ঘৃণাভরে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। তারা অন্যের ওপর দিয়ে যুগে যুগে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
প্রায় চার হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদি জনগণ এবং ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিক ছিল এর অভিযোজন এবং অবিচ্ছিন্নতা। প্রাচীন মিসর বা ব্যাবিলনিয়া সা¤্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিক পশ্চিমা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সাথে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে ইহুদিবাদকে। প্রতিটি গোষ্ঠী এবং মতাদর্শ থেকে বেশ কিছু জিনিস ইহুদি সমাজ-ধর্মীয় কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যও কখনও ক্ষুণœ হয়নি।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে থাকল। এ জন্য যে তারা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফরি করত এবং নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করত। কারণ তারা ছিল নাফরমান ও সীমা লঙ্ঘনকারী।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৬১) ইহুদি নামকরণ ও ইহুদি জাতির গোড়ার ইতিহাস- হজরত ইসহাক (আ.)-এর পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধররা বনি ইসরাইল নামে পরিচিত। বনি ইসরাইল হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধরদের একটি শাখা। এ শাখারই একটি অংশ পরবর্তীকালে নিজেদের ইহুদি নামে পরিচয় দিতে থাকে। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামের অংশবিশেষ থেকে ‘ইহুদি’ নামকরণ করা হয়েছিল। (তাফসিরে মাওয়ারদি : ১/১৩১) যুগে যুগে ইহুদিদের অপকর্ম ও ঐতিহাসিক শাস্তি ইহুদি জাতিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভুগেছেন হজরত মুসা (আ.)।
২৫০০ বছর আগে প্রাচীন পৃথিবীর ইহুদিরা নিজেদের একেশ্বরবাদী ধর্মের ঐতিহ্যে লালিত ‘শ্রেষ্ঠ’ জাতি তথা ‘বনি ইসরাইল’ মনে করত। তাদের ধর্মীয় প্রধান পুস্তক ‘তৌরাত’ অনেকগুলো অনুচ্ছেদে বিভক্ত ছিল যথাক্রমে পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী ইত্যাদি। তৌরাতের নবীদের কাহিনীর অনুচ্ছেদগুলো ছিল যথাক্রমে ইউশা, কাজীগণ, রূত, শামুয়েল, বাদশানামা, খান্দাননামা, উযায়ের, নহিমিয়া, ইস্টের, আইয়ুব, জবুর শরীফ, মেসাল, হেদায়েতকারী, সোলায়মান, ইশাইয়া, ইয়ারমিয়া, মাতম, ইহিষ্কেল, দানিয়েল, হোসিয়া, যোয়েল, আমোস, ওবদিয়, ইউনুস, মিকাহ্, নাহুম, হাবাক্কুক, সফনিয়, হগয়, জাকারিয়া, মালাখি ইত্যাদি। এ ছাড়াও তৌরাতে দুনিয়ার ইতিহাস, সৃষ্টি, আদম ও হাওয়া, আদন বাগান, হাবিল কাবিল, শিস ও তার বংশধর, নুহ, হাম-সাম, ভাষার জন্ম, ব্যাবিলন, ইসরাইল জাতির আদি পিতারা, ইব্রাহিম, লুত জাতি, হাজেরা ও সারা, আবিমালেক, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, ফেরাউন, এহুদা, বনি ইসরাইল, মুসা ও ইশাইয়া নবী, ইয়ারমিয়া, ইহিস্কেল, দানিয়েল, হোসিয়া, যোয়েল, মিকাহ, হাবাক্কুক, সফনিয়, জাকারিয়া, মালাখি, মিসরের ঘটনা, ইমাম, কোরবানি, ঈদ, বিশ্রাম, মানত, তুর পাহাড়, আদম শুমারি ইত্যাদি উপ-ভাগ ছিল। ‘তৌরাত’ ছাড়াও ইহুদিরা প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক হিসেবে ‘জবুর’কেও পবিত্র আসমানি কিতাব মনে করত। জবুরে ১৫০টি ধর্মীয় গান ছিল, যার রচনাকাল ছিল ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। তাদের মতে, এর ৭৩-টির রচয়িতা ছিল ‘দাউদ নবী’ নিজে। এ ছাড়া আসফ ১২টি, কারুণের ছেলে ১০টি, সোলায়মান নবী ২টি, মুসা ১টি, এথন ১টি ও উযায়ের নবী ১টি গান রচনা করেছিলেন। সোলায়মান, হিস্কিয়ের, আগুর ও বাদশাহ লমুয়েলের উপদেশ গ্রন্থ ‘মেসাল’ নামে বিখ্যাত ও পাঠ্য ছিল ইহুদি জাতির কাছে। যা পরবর্তীতে খ্রিস্টানরা ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ হিসেবে বাইবেলে লিপিবদ্ধ করে। আসলে বাইবেল ছিল নিউ ও ওল্ড টেস্টামেন্টের সমন্বয়, তথা ইহুদি ধর্ম ও যীশুর জীবন কাহিনীর ইতিহাস ছিল।
ইহুদিরা পবিত্র ও সতী-সাধ্বী নারী হযরত মরিয়ম (সা.)-এর ওপর ব্যভিচারের জঘন্য অপবাদ আরোপ করেছিল। তারা এ অপবাদ রটিয়ে হযরত ঈসা (আ.) কে মরিয়মের ব্যভিচারের ফসল হিসেবে তুলে ধরে এবং এর মাধ্যমে এটা দেখাতে চেয়েছে যে, ঈসা (আ.) নবী বা পথ-প্রদর্শক হওয়ার উপযুক্ত নন। আর এ অপবাদের ভিত্তিতেই ইহুদিরা ঈসা (আ.)-কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে এমন জঘন্য অপবাদ প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, এমনকি তাঁকে হত্যারও ষড়যন্ত্র করে। ইহুদি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করতে পেরেছিল বলেও এক ধরনের ধাঁধা বা ভুল ধারণার শিকার হয়। আর ওই হত্যাকা-ের ভিত্তিতে অত্যন্ত দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তারা বলেছিল, আমরাই ঈসাকে হত্যা করেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআনে বলছেন যে, আসলে তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল যে ছিল দেখতে ঈসার মত এবং তারা ধোঁকা বা সন্দেহের শিকার হয়েই ওই হত্যাকা- ঘটায়।
কোরআন শরিফের বহু জায়গায় এর বিশদ বর্ণনা এসেছে। সুরা বাকারার শুরুর দিকে ইহুদি জাতির ওপর আল্লাহর রহমত এবং প্রায় ১২টি কুকর্ম ও আল্লাহর পক্ষ থেকে এর শাস্তির বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ তাদের মিসরের ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করার পর মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত আনার জন্য গেলে তারা গরুর বাছুরের পূজা আরম্ভ করে। আল্লাহ তাদের এর শাস্তি দিয়ে ক্ষমা করার পর আবার তারা বায়না করে বসে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার জন্য। এ জন্য তাদের ওপর ফেরেশতার মাধ্যমে তুর পাহাড় উঠিয়ে শাস্তির ভয় দেখানো হয়। মুসা (আ.)-এর দোয়ায় তাদের জন্য কুদরতি খাবারের ব্যবস্থা করা হলে তারা অকৃতজ্ঞ হয়ে তা খেতে অস্বীকার করে। কখনো তারা মুসা (আ.)-এর ওপর খারাপ অসুস্থতা ও ব্যভিচারের অপবাদ দেয়। এভাবে হজরত মুসা (আ.) আজীবন তাদের নিয়ে কষ্ট করেন।
হজরত ইলিয়াস (আ.) ইহুদিদের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ইহুদিদের বিরাগভাজন হয়ে নির্যাতনের শিকারই শুধু হননি, তারা তাকে হত্যার জন্যও উদ্ধ্যত হয়। পরিণামে আবার তাদের ওপর মিসরের জনৈক স¤্রাট চড়াও হয়ে হত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। তারপর অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়। অতঃপর আবার অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে তাদের ওপর বাবেল স¤্রাট বুখতে নসর চড়াও হয়। স¤্রাট বায়তুল মাকদিসে আক্রমণ চালিয়ে মসজিদে আকসা ধ্বংস করে দেয়। হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শহরটি উজাড় করে দেয়। এরপর ইহুদিরা বায়তুল মাকদিস থেকে নির্বাসিত হয়ে বাবেলে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে চরম লাঞ্ছনা ও দুর্গতির মধ্যে ৭০ বছর পার করে। অতঃপর জনৈক ইরান স¤্রাট বাবেল দখল করে ইহুদিদের ওপর দয়াপরবশ হয়ে তাদের আবার সিরিয়ায় পৌঁছে দেয়। এ সময় তারা আবার মসজিদে আকসা নির্মাণ করে। অতঃপর ঈসা (আ.)-এর জন্মের ১৭০ বছর আগে আবার তারা পাপে লিপ্ত হলে আন্তাকিয়ার স¤্রাট তাদের ওপর চড়াও হয়ে ৪০ হাজার হত্যা করে এবং ৪০ হাজার বন্দি করে। স¤্রাট মসজিদে আকসারও অবমাননা করে। এর অনেক বছর পর বায়তুল মাকদিস রোম স¤্রাটের দখলে চলে গেলে সে ইহুদিদের সাহায্য করে।
ইহুদি ধর্মের মূল শিক্ষা প্রায় সবসময়ই একেশ্বরবাদকে করে আবর্তিত হয়েছে। ইহুদিদের মধ্যে অনেক শ্রেণি-উপশ্রেণী থাকলেও এই একটি বিষয়ে কারও মধ্যে দ্বিমত নেই। সবাই একবাক্যে কেবল এক ঈশ্বরকে মেনে নেয়। একেশ্বরবাদ প্রকৃতপক্ষে সর্বজনীন ধর্মের ধারণা দেয় যদিও এর সাথে কিছুটা স্বাতন্ত্র্যবাদ (particularism) যুক্ত রয়েছে। প্রাচীন ইসরাইলে এই স্বাতন্ত্র্যবাদ নির্বাচনের রূপ নিয়েছিল। নির্বাচন বলতে ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের মধ্য থেকে কাউকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করাকে বোঝায়। সেই তখন থেকেই ইহুদিরা মনে করত, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে একটি পূর্বপরিকল্পিত চুক্তিপত্র (কোভেন্যান্ট) থাকতে বাধ্য; সবাইকে এই চুক্তিপত্র মেনে চলতে হবে; না চললে পরকালে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ইহুদিদের এই চিন্তাধারার সাথে messianism এর সুন্দর সমন্বয় ঘটেছিল।
আজ ইহুদিরা তাদের নাশকতামূলক কর্মকা- ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের তুঙ্গে অবস্থান করছে। আমরা বর্তমানে আমাদের ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সূচানলগ্নে প্রবেশ করেছি এবং আমরা তাদের কুৎসিত চেহারা উন্মোচন করার পর্যায়ে রয়েছি ওই সময় যখন মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করবেন। যেমনভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথমবার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে পৃথিবীতে তাদের গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে অথবা তাঁর সাথে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করব এবং তাদের আধিপত্য, গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকামিতার ধ্বংস সাধন করব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Nur mohammad ২৫ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:১২ পিএম says : 0
ভালো লাগলো। তবে আরো বিস্তারিত কিছু লিখলে ভালো হতো
Total Reply(0)
আলী হাসান কাজল ১৪ জুন, ২০২০, ৯:৫৩ পিএম says : 0
কিছু জানার ইচ্ছে ছিলো ইহুদি সম্প্রদায় সম্পর্কে তাই জেনে নিলাম।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন