সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : নিজের পদোন্নতি নিজে নিয়ে সঙ্কট তৈরি করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. জাহাঙ্গীর কবীর। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে তিনি প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি নিয়েছেন। তার পদোন্নতি নেয়াটা যে সঠিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে নাÑ এমন বক্তব্য পদোন্নতি সংক্রান্ত বোর্ডের একাধিক সদস্য উপস্থাপন করলেও তিনি তা আমলে নেননি। বরং পাউবো’র ডিজি এবং কমিটির সভাপতি এই দুই পদের প্রভাব খাটিয়ে বিধিবহির্ভূত কাজটি তিনি করেন। তার বিতর্কিত এই পদোন্নতিকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা অনৈতিক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদোন্নতির মাধ্যমে তিনি অনৈতিকভাবে সরকারের অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। যা আইনি দৃষ্টিতে বড় ধরনের অপরাধ।
এদিকে, পাউবো মহাপরিচালক মো: জাহাঙ্গীর কবীরের এই অনিয়মকে কেন্দ্র করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবো জুড়ে আলোচনার ঝড় বইছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুখে মুখে এই আলোচনা। প্রতিষ্ঠানটির অনেকেই এমন মন্তব্যও করেছেন যে, ডিজি কথায় কথায় নীতিবাক্য শোনালেও তার কর্মকা-েই প্রমাণিত হয়েছে তিনি নিজে কতটা নীতি মেনে চলেন। জানা গেছে, ইতোমধ্যেই তিনি তার অনিয়মকে জায়েজ করার জন্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি নেয়ার দপ্তরাদেশও জারি করেছেন।
গত ৯ আগস্ট জারি করা ওই দপ্তরাদেশে বলা হয়েছে, পাউবো’র প্রকৌশল ক্যাডারভুক্ত এই কর্মকর্তাকে প্রধান প্রকৌশলীর শূন্য পদে (পে গ্রেড-২ ও জাতীয় বেতন স্কেল ৬৬০০০-৭৬৪৯০ টা:) পদোন্নতি প্রদান করা হলো। এই কর্মকর্তা বর্তমান কর্মস্থলে নিয়োজিত থেকেই পদোন্নতি প্রাপ্ত পদে যোগদান করবেন। পাউবো মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে এই আদেশ জারি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির উপ-সচিব (প্রশাসন) ওবায়দুল ইসলাম।
এদিকে, এই পদোন্নতিকে ২০০৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন (তৎকালীন সংস্থাপন) মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রের পরিপন্থী (স্মারক নং-সম/উনি-৪/২-৪/৯১ (অংশ-২)-১৪৬) বলেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
জনপ্রশান মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ড. মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত সরকারি ও স্বশাসিত সংস্থার উচ্চতর পদে নিয়োগ/পদোন্নতি সংক্রান্ত ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, কার্যবিধিমালা অনুসারে নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব সংস্থাপন (জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/বিভাগ-এর অধীন দপ্তর/ অধিদপ্তর/ স্ব-শাসিত সংস্থা এই পরিপত্র লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। এই প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়/বিভাগ-এর সচিবের সভাপতিত্বে ‘বিভাগীয় পদোন্নতি/নিয়োগ বোর্ড’ গঠন না করে দপ্তর, সংস্থা প্রধানের সভাপতিত্বে কমিটি গঠনপূর্বক ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ গ্রেডের পদে পদোন্নতি, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদানের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে। সংস্থাপন (জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয় আরো লক্ষ্য করছে যে, জাতীয় বেতন স্কেলের ১ম, ২য় ও ৩য় গ্রেডের পদসমূহে পদোন্নতি/নিয়োগ-এর প্রস্তাব এসএসবি’র বিবেচনা ও সুপারিশের জন্য প্রেরণ না করে বিভাগীয় পদোন্নতি/নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক নিষ্পত্তির প্রয়াস নেয়া হচ্ছে। যা সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় সকল দপ্তর, অধিদপ্তর এবং স্ব-শাসিত সংস্থায় উচ্চতর পদে নিয়োগ/পদোন্নতি/ উচ্চতর টাইমস্কেল/সিলেকশন গ্রেড প্রদানের প্রস্তাব যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দেয়া গেল।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এই প্রজ্ঞাপনের আলোকে পাউবো’র বর্তমান মহাপরিচালক যে বোর্ডের মাধ্যমে পদোন্নতি নিয়েছেন, সেই বোর্ডের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আরও প্রশ্ন উঠেছে, এসএসবি’কে পাশ কাটিয়ে কীভাবে ২য় গ্রেডের এই পদোন্নতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলো। তদুপরি পদোন্নতি সংক্রান্ত কমিটির সভায় তিনি নিজে সভাপতিত্ব করে নিজের পদোন্নতি কীভাবে নিলেন? এ ব্যাপারে পাউবো’র সাবেক মহাপরিচালকরা মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটির সততা ও এর ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের স্বার্থেই এই দপ্তরাদেশ বাতিল হওয়াটা অপরিহার্য।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, এটা কীভাবে সম্ভব? এটা কোনভাবেই হতে পারে না। তিনি নিজে সভাপতিত্ব করে নিজের পদোন্নতি নেন কীভাবে। উনি এটা করতে পারেন না। তাছাড়া তার পদ গ্রেড ২-এর পদোন্নতির বিষয়টি সম্পূর্ণ এসএসবি’র এখতিয়ার। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এই পদোন্নতির বিষয়টি সত্যি হলে তা ভয়াবহ অনিয়মের পর্যায়েই শুধু পড়বে না; এটি হবে বিধি-বহির্ভূত কর্মকা-Ñ যা অপরাধের শামিল।
পাউবো’র সাবেক মহাপরিচালক মোজাদ্দেদ আল ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, দপ্তর প্রধান হিসেবে পাউবো মহাপরিচালক মো: জাহাঙ্গীর কবীরের এ ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত ভুল হয়েছে-এটা যে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে টিকবে না। তাছাড়া পাউবো’র মত একটি প্রতিষ্ঠানে এরকম বাজে দৃষ্টান্ত রাখাটা ঠিকও হবে না। তিনি বলেন, এটাতো বেসিক প্রিন্সিপাল যে, যার সম্পর্কে আলোচনা তার সেখানে উপস্থিত থাকাটা ঠিক নয়। আর খোদ সভাপতি নিজেই নিজের পদোন্নতি কীভাবে নেন? এটা একবারেই নিয়ম বহির্ভূত।
পাউবো’র আরেক সাবেক মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, যে প্রক্রিয়ায় এই পদোন্নতি নেয়া হয়েছেÑ এটা অপরাধ। এই পদোন্নতি কার্যকর হলে পাউবো’তে কোন অনিয়মের বিরুদ্ধেই আর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় পাউবো’র ভাবমর্যাদা সঙ্কটের কবলে পড়বে।
উল্লেখ্য, গত ৮ আগস্টে পাউবো’র সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সরকারি চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে নিজের পদোন্নতি নিজে নেয়ার এই ঘটনা ঘটে। আর ৯ আগস্ট পাউবো থেকে এ সংক্রান্ত দপ্তরাদেশ জারি করা হয়।
এদিকে, পাউবো মহাপরিচালক নিজের পদোন্নতি নিজেই নিতে পারেন কীনা এবং তার এই পদোন্নতি বিধিসম্মত হয়েছে কীনা এ নিয়ে তোলপাড় চলছে গোটা পানি উন্নয়ন বোর্ড জুড়ে। এই পদোন্নতি নিয়ে পাউবো’তে যেমন আলোচনার ঝড় বইছে; তেমনি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে একজন সিনিয়র মন্ত্রী যিনি ইতোপূর্বেও একবার পানি সম্পদ মন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন- তার অধীনস্থ একটি দপ্তরে এমন নিয়মবহির্ভূত ঘটনা কীভাবে ঘটলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন ঊঠেছে- একজন ব্যক্তিকে পরপর তিনটি উচ্চপদে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা যায় কীনা? একই সাথে একজন জুনিয়রের অধীনে একজন সিনিয়র চাকরি করতে পারেন কীনা?
গত ৮ আগস্টে পাউবো’র বাছাই কমিটি-১ এর সভায় কমিটির চেয়ারম্যান ও বোর্ডের মহাপরিচালক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগাœ-সচিব, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ), অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ইস্টার্ন রিজিওন), অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ওয়েস্টার্ন রিজিওন) এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ধরনের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এনএসআই এবং সিটি এসবি’র প্রতিবেদন থাকাটা অপরিহার্য হলেও এক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিবেদন ছাড়াই মহাপরিচালক তার নিজের পদোন্নতি নিজেই নিয়েছেন বলে প্রশ্ন উঠেছে।
অজ্ঞাত কারণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় একাধিক্রমে তিনটি চলতি দায়িত্ব দিয়ে মোঃ জাহাঙ্গীর কবিরকে মহাপরিচালক পদে বসান। সরকারি চাকরিবিধিমালা অনুযায়ী পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোন জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা যাবে না. যদিনা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের বিভাগীয় মামলা না থাকে। জানা যায়, তাকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং এর তিন মাসের মধ্যেই মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়। একজন ব্যক্তিকে মহাপরিচালক বানাতে কেন এই নিয়মের ব্যত্যয় এ নিয়েও নানা মহলে চলছে গুঞ্জন।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে মোঃ জাহাঙ্গীর কবির অজানা কারণে সচিব মর্যাদার সমতুল্য ডিজি পদে আসীন করা হয়। কিন্তু চাকরি বিধিমালা মোতাবেক তাকে ডিজি পদে পদোন্নতি দেয়ার আগে তার সিনিয়র হিসেবে যিনি রয়েছেন তার বিষয়টি সুরাহা করা দরকার ছিল। প্রয়োজন তাকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে দিয়ে কিম্বা তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া যেত। কিন্তু তা না করে পাউবো’তে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যার সুরাহা হওয়টিা প্রতিষ্ঠানটির স্বাথেই অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন