বাড়ির পাশে আরশিনগর। বলতে গেলে রাজধানী ঢাকার সদর দরজা ঘেঁষেই চলছে বাণিজ্যের ধুন্ধুমার কান্ড। তা হলো ভুলতার গাউছিয়া হাট। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সারা দেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের বিপণন-তীর্থ হয়ে ওঠে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের এই মোকাম। প্রায় তিন যুগ ধরে চলছে এই কাপড়ের হাট। আর দিন যত গড়াচ্ছে, এর ব্যাপ্তিও তত বেড়ে চলেছে। এই বস্ত্র-হাটের অলিগলিতে আলো-আঁধারিতে দোকানগুলোতে হাজারো ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। ব্যবসায়ীদেরও দিনরাতের ফারাক থাকে না। সপ্তাহের একটি দিন মঙ্গলবারে এখানে বিক্রিবাট্টা হয় অবিশ্বাস্য অঙ্কে, প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বিশেষত্ব হলো, এই হাটের অধিকাংশ ক্রেতাই নারী। এই হাটকে ঘিরেই সারা দেশের ৩০ হাজার নারীর ভাগ্যের চাকা সচল হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর হওয়ার বেশ আগেই গাউছিয়া মার্কেটে শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক। ক্রমেই বাড়তে থাকে দরদামের কোলাহল, কুলিদের ব্যস্ততা। মার্কেটের সামনে থাকে ভ্যান-রিকশার দীর্ঘ সারি। হাটের গা ঘেঁষে সড়কে থাকে ট্রাকের বহর। কাপড়ের বিশাল গাঁট উঠছে, নামছে। লোড নিয়ে চলেছে দূর-অদূর গন্তব্যে। একসময় কেবল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও চাদরের জন্য যে গাউছিয়া হাটের সুখ্যাতি ছিল তার প্রশস্ততা বেড়েছে অনেক। বর্তমানে হাটটি দেশের বড় তাঁতবস্ত্র বিপণনকেন্দ্র। রুমাল থেকে জামদানি শাড়ি, মাথার টুপি থেকে পাঞ্জাবি সব মেলে এই হাটে।
চট্টগ্রাম, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ দেশের সব প্রান্তের পাইকারি ক্রেতার ভিড়ে মুখর থাকে গাউছিয়া হাট। ব্যবসায়ীদের কোনো টোল জমা, খাজনা বা চাঁদা দিতে হয় না। চোর-বাটপার, ছিনতাইকারীর উৎপাতও নেই।
গতকাল মঙ্গলবারের চিত্র। ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর সাড়ে ৫টা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নীরব-সুনসান। অল্প কিছু দূরে কয়েকজন করে নারীর খন্ড খন্ড জটলা। কারো হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। আবার কারো হাতে চটের বস্তা। কেউ বা এসেছে নোয়াখালী বা চট্টগ্রাম থেকে। আবার কারো বাড়ি যশোর, জামালপুর বা পটুয়াখালীতে। দারিদ্র্যজয়ী ওরা একেকজন জীবন-যুদ্ধের অগ্রসেনানি। সবাই আজ স্বাবলম্বী। প্রতি মঙ্গলবার সারা দেশের প্রায় ৩০ হাজার নারী রূপগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেটে সমবেত হয়। আর এই মার্কেট ঘুরিয়ে দিয়েছে ওদের ভাগ্যের চাকা।
মার্কেট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, রাজধানী থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে ভুলতা এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গাউছিয়া মার্কেটটি গড়ে ওঠে ১৯৭৯ সালে ছোট্ট পরিসরে। মার্কেটের প্রথম ভবন গড়ে ওঠে ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। ধীরে ধীরে ১২০ বিঘা জমির ওপর মার্কেট সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে গাউছিয়া-১ ও গাউছিয়া-২ মার্কেটে পাইকারি কাপড়, শাড়ি, ওড়না, লুঙ্গি, গামছা বিক্রি হয়। নারী ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দারিদ্র্যজয়ের গল্প। সকাল ৬টার দিকে মার্কেটের ভেতরে কথা হলো ষাটোর্ধ্ব কুলসুম বেগমের সঙ্গে। কুলসুম বেগম বলেন, বাজান এহানতে কাপড় কিনা ভালাই আছি। দামে কম পাই। আর নাইলে কি হেই জামালপুরতে আহি। জুলেখা বেগম বলেন, আল্লায় ভালাই রাখছে বাজান। সোয়ামী মইরা যাওনের পরে দিশাহারা অইয়া গেছিলাম। কুলসুম বুবু আমারে পথ দেহাইছে। আমি অহন ভালা আছি। এহানকার কাপড়ের দাম কম। কিনা লাব (লাভ) পাই।
গাউসিয়া মার্কেটের দোকান মালিকরা জানান, গাউসিয়া মার্কেটে পাইকারী কাপড়ের দোকান রয়েছে সাড়ে ৪ হাজারের উপড়ে। তবে এসব দোকান সবগুলো খোলা থাকে মঙ্গলবার। অন্যদিনগুলোতে কিছু দোকান বন্ধ থাকে। মঙ্গলবারে একেকটি দোকানে বিক্রি হয় কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। আবার কোনো কোনো দোকান ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি করে। রহিম শাড়ি-কাপড় বিতানের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, ভাই ব্যবসা ভালাই। তয় দেশের পরিস্থিতি খারাপ অইলে ব্যবসা মন্দা হয়। আমাগো কাস্টমার সব মহিলা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেইক্যা আহে। তাই পরিস্থিতি খারাপ অইলে মনডা খারাপ অইয়া যায়গা। আগে বেচবার পারতাম দেড়-দুই লাখ টাকা। অহন বেচি মাত্র ৪০-৫০ হাজার টাকা। করোনায় ব্যবসায় ধ্বস নামাইয়া দিছে।
মার্কেটের ম্যানেজার আব্দুল আউয়াল বলেন, মার্কেটে সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার নারী ক্রেতারা আসে এটা ভাগ্যের বিষয়। তাই নারী ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেন ছিনতাই, চুরি কিংবা ডাকাতির ঘটনা না ঘটে। মার্কেটের পাশেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। তাছাড়া রয়েছে নিরাপত্তাপ্রহরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন