রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাজারে চালের দাম বাড়ছে হুহু করে। খোদ কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক স্বীকার করেছেন ৩২-৩৩ টাকার মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ টাকায়; কেন এই মৃল্যবৃদ্ধি তার কারণ জানেন না মন্ত্রী। মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ চাল আমদানিতে শুল্ক ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গতকাল রোববার এক অনলাইন সংবাদ সংম্মেলনে বলেন, কেবল বৈধ আমদানিকারকরা ১০ জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয়ে আমদানির আবেদন করবেন। সেখান থেকে মন্ত্রণালয় কাকে কী পরিমাণ চাল আমদানি করতে দেবে সেই সিদ্ধান্ত জানাবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণা বলছে, পরপর চার দফা বন্যায় এবার ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতে ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদন হতে পারে। কিন্তু তারপরও যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হবে, তা দিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়েও কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এখন আমনের ভরা মৌসুম চললেও ধান ও চাল-দুটোরই দাম গতবছরের তুলনায় বেশি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ২৩ ডিসেম্বরের যে তথ্য দেয়া আছে, তাতে সরকারি গুদামগুলোতে মোট ৭ দশমিক ৪৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল ৫ দশমিক ৪২ লাখ মেট্রিক টন এবং গম ২ দশমিক ৪ লাখ মেট্রিক টন। চালের মজুদের এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
দেশের বাজারে চিকন চালের দাম এখন প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) ৩২০০ টাকা থেকে ৩৪০০ টাকার মধ্যে, যা সা¤প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় প্রতিকেজি সরু চালের দাম পড়ছে ৬৪ টাকা থেকে ৬৬ টাকার মধ্যে। সরু চালের সাথে পাল্লা দিয়ে মাঝারি ও মোটা চালের দামও বেড়েছে।
চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, চালের দাম কেন এত বাড়বে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। কেজিতে চালের দাম ১-২ টাকা বাড়াও কিন্তু অনেক বাড়া। সেখানে ৩২-৩৩ টাকার মোটা চাল ৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারণগুলো কি? দেশের মিলার, আড়তদার ও জোতদাররা যারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা চালের দাম বাড়ায় এবং এবারও তারা সেই কাজ করছে। মৌসুমের সময় তারা এখনও ধান কিনছে এবং ধান ও চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা উদ্যোগ নিয়েছি ভারত থেকে এবং অন্যান্য দেশ থেকে চাল আনার। ২৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা যাবে। প্রাইভেট সেক্টরকেও সেই সুযোগ দেওয়া হবে। প্রাইভেট সেক্টর এবং সরকার ৫/৬ লাখ টন চাল আনতে পারবে। এর বেশি হলে আমরা আর অনুমতি দেবো না। যখনই ৬ লাখ টনের এলসি দেওয়া হবে তারপর আর এলসির সুযোগ দেওয়া হবে না।
এখন আমনের ভরা মৌসুম চললেও ধান ও চাল-দুটোরই দাম গতবছরের তুলনায় বেশি। সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর ইরি বা স্বর্ণার মত মোটা চালের দাম ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। মাঝারি মানের চাল পাইজাম বা লতার দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই পরিস্থিাতিতে ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, রেশনসহ অন্যান্য সরকারি প্রয়োজনে দরপত্র ও জিটুজি ভিত্তিতে চাল আমদানি করছে সরকার।
‘নিয়ন্ত্রিত মাত্রায়’ চাল আমদানির অনুমতির কথা ঘোষণা করে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চালের দাম নিয়ে ভোক্তাদের যাতে কষ্ট না হয়, আবার কৃষকও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আমদানির মাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেই ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলেন, কেবল বৈধ আমদানিকারকরা অনুমোদন পাওয়ার পর কে কী পরিমাণ আমদানি করেছে সেই হিসাব রাখা হবে। ইতোমধ্যে ভারতের বাজার থেকে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে এক লাখ টন চাল আমদানি শুরু করেছে সরকার। সর্বমোট চার লাখ টন চাল সরকারিভাবে আমদানির দরপত্র সচল হয়েছে বলে সাংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশে ১৯ হাজার ৭৩৪টি চালকল বা চাতাল রয়েছে। প্রতিটি চাতালে ৫০০ থেকে এক হাজার বস্তা চালের মজুদ থাকে। ছোট ছোট মুদি দোকানগুলোতেও ৫/১০ বস্তা চাল মজুদ থাকে। সেই হিসাবে দেশে এখনও (সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে) ৩০ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে বলে আমরা হিসাব করছি। কিন্তু বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য আরও প্রয়োজন। উপজেলা শহরের হাটবাজারগুলোতে ধানের দামও ‘বেশ বাড়তি’ জানিয়ে তিনি বলেন, এতে কৃষক ‘কিছুটা লাভবান’ হচ্ছেন। আমরা প্রতিমণ ১০৪০ টাকা করে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য বাজার উন্মুক্ত রেখেছি। কিন্তু বাজারে এখন ধানের দাম ১২০০ টাকা। কৃষক সরকারের কাছে না বিক্রি করে বেশি দামে অন্যত্র বিক্রি করছে। এ বছর সরকার ৩৭ টাকা কেজি দরে চাল এবং ২৬ টাকা কেজি দরে ধান কিনছে। কিন্তু খোলা বাজারে কৃষক আরও ভালো দাম পাওয়ায় ওই দামে ধান কিংবা চাল কিনতে পারেনি সরকার। চুক্তিবদ্ধ মিলাররাও লোকসানের কথা বলে চাল সরবরাহ থেকে বিরত থেকেছে।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, চলতি অর্থবছরে চাহিদার তুলনায় ২৯ লাখ টন ধান বেশি উৎপাদন হয়েছে। আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। বিদেশ থেকে আমদানি করছি ব্যালেন্স করার জন্য। আমাদের ভোক্তাকেও দেখতে হবে আবার কৃষককেও দেখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন